খোকা থেকে বাঙালি জাতির জনক

মোঃ আল মাহমুদ | ১৫ আগষ্ট ২০২১, ২২:৪৬

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা একটি ছোট্ট গ্রাম টুংগীপাড়া । সেই গ্রামে বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়রা খাতুনের কোল আলো করে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন একটি ছেলে নাম তার শেখ মুজিবুর রহমান । কে জানত সেদিনের এই ছেলেই বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে দিতে পারার মত একজন অবিস্মরণীয় নেতা হবে । যে মানুষটির শৈশব কেটেছে টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে , মেঠো পথের ধুলো বালি মেখে এবং বর্ষার পানিতে ভিজে সেই মানুষটি আবার হাজার নির্যাতন জেল জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করে এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছে । ছোটবেলা থেকেই তার মাঝে লক্ষ্য করা গেছে দেশপ্রেম । সাধারণ মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং উদার প্রকৃতির মানসিকতার ।গ্রামবাসীর কাছে মিয়াভাই এবং পরিবারের সদস্যদের কাছে খোকা বলেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি।

মানুষের বিপদে-আপদে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা সেই ছোট্টবেলা থেকেই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল । এক গরীব ছেলেকে তার শতছিন্ন কাপড় দেখে নিজের পরনের পাজামা-পাঞ্জাবি দিয়ে নিজের গায়ে চাদর জড়িয়ে বাড়িতে আসার ঘটনা হয়তো তারই উদাহরণ ।মূলত কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলের থাকাকালীন সময়ে হলওয়ে মনুমেন্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন সক্রিয়ভাবে এবং এভাবেই তার রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয়।তারপরে আর পেছনে ফিরে তাকাননি।

যেখানেই দেখেছেন অন্যায়-অনিয়ম অত্যাচার তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন সংগ্রাম ও আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। অন্যায় কে কোনদিনই প্রশ্রয় দেন নি ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে তিনি কখনো পিছপা হননি ।তাইতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন ও অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে গ্রেপ্তার হন ।এরপর থেকেই বাংলার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে কান্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু এ বিষয়ে বক্তব্যে যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন ফুলে ফুঁসে উঠে বাংলার ছাত্র সমাজ ।বাদ যাননি শেখ মজিবর রহমান । ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯৪৯ সালে গ্রেফতার হন । বন্দি ছিলেন ১৯৫২ সাল পর্যন্ত । এসময় জেলে থেকেই তার সংগ্রামী সাথীদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন , অনশন ধর্মঘটের মত প্রতিবাদ সমাবেশ গ্রহণ করেছেন।

এরপর থেকে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন ,১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা , ১৯৬৯ সালে ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন ,গণঅভ্যুত্থান সব মিলিয়ে গণমানুষের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন সেই ছোট্ট খোকা । তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে ২৩ শে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (তৎকালীন সোহরাওয়াদী উদ্যানে ) এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত
করা হয়।

তিনি যে তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সকল অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে আপন মহিমায় গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তারই প্রতিফলন ঘটে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করার পরেও যখন পাকিস্তানি সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা রকম টালবাহানা শুরু করে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত বাংলার মুক্তি
অসম্ভব। তাই তো ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লাখো লাখো জনতার সামনে উচ্চারিত করেন তাঁর অমর-কবিতাখানিঃ

"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম "।

"তোমাদের যাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে"। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল "। এই ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বাংলার প্রতিটি সংগ্রামী জনতাকে মুক্তির নেশায় উদ্বুদ্ধ করে যান । ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলেও তার আগেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং বাংলার প্রতিটি মুক্তিকামী জনতার মাঝে স্বাধীনতার বীজ বপন করে যান। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ । দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ও তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পেয়ে যাই ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর মহান বিজয়। এই স্বাধীনতার বিজয়ের যে মহানায়ক তারই প্রতীক্ষায় বাংলার প্রতিটি মানুষ যেন প্রতীক্ষায় দিন গুনতে থাকে। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন । বাঙালি জাতি তাকে মহান স্বাধীনতার স্থপতি ,জাতির জনক ঘোষনা করেন এবং দেশ গড়ার মহান দায়িত্ব তাকে তুলে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার মহান দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন তিনি । কিন্তু বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে নেমে আসে এক কালো অধ্যায় । ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । ঘাতকরা চেয়েছিল তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব নামক অধ্যায়টি বাংলার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে কিন্তু তারা জানেনা এক মুজিব মারা যাওয়ার মধ্য দিয়ে এদেশের স্বাধীনতা থেকে তার নামটি কখনো মুছে ফেলা সম্ভব নয় ।তাইতো আজও বাংলার মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি , মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে । তাঁর চেতনা এবং আদর্শকে বুকে ধারণ করে চলতে হবে হাজারো পথ । তিনি আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন চির অম্লান হয়ে । তাই তো কবির ভাষায় -

"যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মজিবুর রহমান "।

লেখকঃ
মোঃ আল মাহমুদ
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: