নারী দিবস: প্রত্যাশা ও বাস্তবতার ফারাক

নোমান বিন হারুন | ৯ মার্চ ২০২৪, ১০:০০

নোমান বিন হারুন
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর কাজের স্বীকৃতি প্রদান, নারী—পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, নারীর সাফল্য উদযাপন ও নারীদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে দিনটি পালিত হয়। কোনও কোনও দেশে নারী শ্রমিক দিবস হিসেবেও দিনটি পালিত হয়।
 
নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘উন্নয়নকে গতিশীল করতে নারীর প্রতি বিনিয়োগ’। নারীর উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আন্তজার্তিক পযার্য়ে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাতে এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিপাদ্যটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে জাতিসংঘ বলছে, কোভিড মহামারী এবং সংঘাতের কারণে ২০২০ সাল থেকে আরও ৭৫ মিলিয়ন মানুষ গুরুতর দারিদ্রের মুখে পতিত হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রের সীমারেখায় থাকা ৩৪২ মিলিয়নেরও বেশি নারীর ভাগ্য পরিবর্তন করতে অবিলম্বে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। অর্থনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যেই এ প্রতিপাদ্য গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি নারীদের প্রতি সহিংসতা রোধে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও যথাযথ পদক্ষেপের উপরও গুরুত্বারোপ করেছে জাতিসংঘ। 
 
নানা আয়োজন আর বর্ণিল আলোকচ্ছটার মধ্য দিয়ে এ দিবসটি পালিত হলেও এর পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। নারীর প্রতি মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১৮৫৭ সালে রাস্তায় নেমে এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা। নিউইয়র্কের রাস্তায় সেদিন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকদের বিক্ষোভে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ সেই মিছিলে অতর্কিত হামলা চালায় সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী। এরপর ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্রেট পার্টির নারী সংগঠনের আয়োজনে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে আয়োজনের পুরোধা ছিলেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন।  
 
ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এ সম্মেলনে ১৭টি দেশের ১০০ জন নারী প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলন থেকে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। এ সম্মেলন থেকেই ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সমঅধিকার দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্বরাই এ দিবসটি পালনে এগিয়ে আসেন। ১৯১৪ সাল থেকেই বিশ্বের বেশকিছু দেশে ৮ মার্চ পালিত হয়। সর্বশেষ ১৯৭৫ সালে এ দিবসটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। জাতিসংঘের আহ্বানে দিবসটি দেশে দেশে পালন করা শুরু হয়। এরপর থেকে কমবেশি বিশ্বের সকল দেশেই যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে। 
 
২০১১ সালে শতবর্ষ পূর্ণ করে এ দিবসটি। অবশ্য ১৯১৭ সালের আগ পর্যন্ত এই তারিখটিও নির্দিষ্ট ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ান নারীরা ‘রুটি ও শান্তি’র দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল। টানা চার দিন ধরে চলা সেই আন্দোলনে অবশেষে সেখানে জার শাসনের অবসান ঘটে এবং অন্তবর্তীকালীন সরকার নারীদের ভোটের অধিকার মেনে নেয়। আন্দোলনের শুরুর দিনে রাশিয়াতে সেদিন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ছিল ২৩শে ফেব্রুয়ারি রবিবার। পরবতীর্তে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তা হয় ৮ই মার্চ। এর ধারাবাহিকতায় এ দিনটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি পায়।
 
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে সংঘাত ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের ৭৫ শতাংশ দেশ জনগণের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নারীস্বাস্থ্য ও নারীদের জরুরি পরিষেবার উপর। জাতিসংঘের হিসেবে ২০৩০ সাল নাগাদ লিঙ্গ সমতা আনতে হলে এখন থেকে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৩৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। এক প্রতিবেদন বলছে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার নারী ও মেয়েদের প্রতি নিপীড়ন মোকাবেলায় মাত্র ৫ শতাংশ সহায়তা দিয়ে থাকে। এর মাত্র ০.২ শতাংশেরও কম এই নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যয় করা হয়। 
 
বিশ্বজুড়ে নানা আয়োজনের ডামাডোলে নারী দিবসের প্রকৃত স্বার্থকতা কতটুকু তা সংঘাতময় এলাকার দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। আফগানিস্তানে তো রীতিমত ঘোষণা দিয়ে মেয়েরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ফিলিস্তিনে চলমান সংঘাতে নিহত ত্রিশ হাজার মানুষের এক বিশাল অংশ নারী। এসবের মাঝে নারীর ক্ষমতায়নের নানা চিত্রায়ন আমাদের হতাশার মাত্রা বাড়ানো ছাড়া আর কিইবা করেছে। আমাদের দেশেও রাষ্ট্রীয় উচ্চপযার্য়ে আসীন নারীদের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে অনেকে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। আর এদিকে শুধু ভাত—কাপড়ের স্বাচ্ছন্দের জীবনের জন্য পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়— এখনো অনেক দূর যাওয়া বাকি। 
 
লেখক: নোমান বিন হারুন
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: