মাহে রমজান ও ঈদ উল ফিতরের ছুটির কারণে অনেকগুলো দিন গ্রামে অতিবাহিত করতে হয়েছে। গ্রামের পারিপার্শ্বিক অবস্থা জানান দেয় যে, এখানে মানুষের মানসিক বিকাশ ও আত্মার বিকাশের এখনও অনেক পথ বাকী।
দীর্ঘদিন গ্রামীন জীবনযাপন অবলোকন করে নবম শ্রেণীর ছাত্রথাকাকালীন সময়ে পড়া তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঞ্চলিক উপন্যাস 'হাঁসুলি বাঁকের উপকথা'র কথা মনে পড়ে গেল। কোপাই নদীর প্রায় বৃত্তাকার বাঁকে (মেয়েদের গলার হাসুলীর মতো) বাঁশবাঁদি। এ গ্রামে কাহার জাতির লোকেরা বাস করে। কাহারেরা ছিল দুটি পাড়ায় বিভক্ত: বেহারা পাড়া এবং আটপৌরে পাড়া। বেহারা পাড়ার প্রধান ছিল বনওয়ারী এবং আটপৌরে পাড়ার প্রধান ছিল পরম। একই জাতির অংশ হলেও দুই পাড়ার মধ্যে মাঝে মধ্যে সংঘর্ষ হত। তবুও দুই পাড়ার লোকজনই দেবতা কত্তাবাবাকে মানত। কত্তা বাবার ছিলেন হাঁসুলী বাঁকের পশ্চিম দিকের শিমুল গাছে।
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র বয়সে প্রবীন সুচাঁদ সমাজের নিয়ম-নীতি, আচার-আচরণ, সংস্কারগুলো সকলকে জানান। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র করালী। সমাজের নির্দিষ্ট আচার-আচরণ, রীতি-নীতি ও সংস্কার (বা কুসংস্কার) যেগুলো সবাইকে মান্য করতে হয় করালী তাতে প্রশ্ন তোলে। করালীই প্রথম যে এই নিয়মগুলো ভাঙ্গে। একসময় কারালী রেলস্টেশনে কুলির কাজ নেয়। এতে বেহারা পাড়ার মাতাব্বর বনওয়ারীসহ অন্যরা আপত্তি তোলে। কারণ তাদের পূর্ব পুরুষেরা বলে গেছেন চন্দনপুরের ওখানে যেতে নেই।। বনওয়ারী পুরনো রীতি নীতিকে আকড়ে ধরে থাকতে চায়, অন্যদিকে করালী যুক্তিবাদী তরুণ যে সমাজের কুসংস্কারগুলোকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে।
ফলে উপন্যাসের পুরোটা জুড়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। বনওয়ারী তার থেকে বয়সে অনেক ছোট সুবাসীকে বিয়ে করলে এ দ্বন্দ চুড়ান্ত রূপ নেয়। এ অসম বিয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে করালী সুবাসীকে বনওয়ারীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়। সুবাসীও করালীর প্রতি আসক্ত ছিল। করালী সুবাসীকে ঘরে নিয়ে গেলে করালীর স্ত্রী পাখি আত্মহত্যা করে। শেষ পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বে বনওয়ারী পরাজিত হয়। করালীর প্রভাবে ধীরে ধীরে কাহার পড়ার পুরানো বিশ্বাসে ভাঙন ধরতে থাকে। কারালী কত্তা বাবার বাহন সাপটিকে পুড়িয়ে মারে যা কুসংস্কারের ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঞ্চলিক উপন্যাস হাঁসুলি বাঁকের উপকথার মতো এখনও গ্রামীণ জনপথগুলোতে মানুষের ভিতর কুসংস্কার, বাল্যবিবাহ, যৌতুকপ্রথা, হীন্যমন্যতা বিদ্যমান। তাই গ্রামীণ সমাজের উন্নতির জন্য মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন ও আত্মার বিকাশ জরুরী।
লেখক
প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর-২০১২
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: