বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙলির জন্য অনুপ্রেরণার

ইমরান বিশ্বাস | ১১ জানুয়ারী ২০২২, ০৯:৪৪

আজ ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। আজকের দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি '৭৫ এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতা ও তার পরিবারের সদস্য সহ স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা সহ মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও বীরাঙ্গনাদের ও এদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী লড়াই সংগ্রামের অগ্রসেনানীদের।

১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালোরাতে গ্রেফতার হয়ে সুদীর্ঘ ৯ মাস কারাগারের অন্ধকারে দুর্বিষহ জুলুম,নিপীড়ন , অত্যাচার সহ্য করে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ জাতির পিতা পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। একটি পাকিস্তান সামরিক বিমানে গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বিমানবন্দরে তাকে রাজকীয় অভ্যর্থনা দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এ্যাডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ বঙ্গবন্ধুকে নজীরবিহীন সম্মান দেখান। ইতিহাস সাক্ষী ঐদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন। ব্রিটিশ সরকার ও তার জনগণদের কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাই।

পিতা তাঁর প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার জন্য ওঠেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে। বাংলাদেশে ফেরার পথে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করে দিল্লীতে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে বিমান বন্দরে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানান। আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ভারত সরকার ও তার জনগণকে। এবার আসি কেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই দিন।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের চিত্র ছিল এ রকম- সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধ মানুষ। বাংলাদেশ বেতার থেকে ধারাবিবরণী দেয়া হচ্ছিল। বিমানবন্দর ও রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষমাণ বীর বিজয়ী জনতা। অন্যরকম উত্তেজনা সবার চোখেমুখে। বাঙালির মহান নেতা আসছেন। রাজপথ লাখো মানুষের দখলে । সবার কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান।অপেক্ষার পালা যেন শেষ হয়না অবশেষে তিনি এলেন। যে দেশ এবং যে স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন মহা বিজয়ের মহানায়ক। বিমানবন্দরে তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীবৃন্দ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ, পরিবারের সদস্য, ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা, আবাল-বৃদ্ধা-বণিতা সবাই অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এই মহা নায়ককে। পরিপূর্ণ বিজয়ের আনন্দে ভেসে যায় তাঁর প্রিয় স্বদেশ।

সেই পবিত্র মাটিতে পা দিয়েই আবেগে কেঁদে ফেলেন। এ কান্না বাঙলা ও বাঙালির জন্যে,এ কান্না বিজয়ের, এ কান্না মুক্তির অপরিমেয় আনন্দের। যা ফুটে ওঠে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে তার ভাষণে - "আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসবো আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও কোন আপত্তি নাই মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙ্গালির কাছে দিয়ে দিও এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।""আপনারা বুঝতে পারেন নম নম নম সুন্দরী মম জননী জন্মভুমি গঙ্গার তীর সিন্ধ সুমীর জীবনও জুড়ালে তুমি"

আজ আমি যখন এখানে নামছি আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষ কে আমি এত ভালোবাসি, যে জাত কে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।"

তিনি শত নিপীড়ন অত্যাচার ভোগ করে মৃত্যুর মুখ থেকে যখন তার প্রিয় পবিত্রভূমিতে আসলেন তখন তার হৃদয়ের সুতীক্ষ্ণ আবেগ আর অনুভূতি এভাবেই তুলে ধরলেন, "আমি আজ বাংলার মানুষ কে দেখলাম, বাংলার মাটি কে দেখলাম, বাংলার আকাশ কে দেখলাম বাংলার আবহাওয়া কে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি বোধহয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।"

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পিতা মুজিবের ভাষণের আর দুইটি অংশ আলোচনা করেই আমি শেষ করবো প্রথমত তিনি স্বপ্ন দেখেছেন বাঙালিদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি বলেন-
"নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা,বাংলার মানুষ হাসবে বাংলার মানুষ খেলবে বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে এই আমার সাধনা এই আমার জীবনের কাম্য আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি এই আশীর্বাদ এই দোয়া আপনার আমাকে করবেন।"

কিন্তু ভাগ্যের কি নিরমম পরিহাস দেশমাতৃকা গড়ার কাজে যখন হাত দেন তার ঠিক মাত্র সাড়ে তিন বছর এর মাথা কিছু কুলাঙ্গার বিপদগামী সেনা সদস্যদের হাতে জাতির পিতার রক্তে ভিজে যায় বাঙলা মায়ের বুক।

পিতা মরে গেলেন তার স্বপ্নের সোনার বাঙলা গড়ার পবিত্র দ্বায়িত্ব নেন তারই আদরের কন্যা, এদেশের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল, গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।

নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি আজ চারচার বারের প্রধানমন্ত্রী দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। আজ আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হয়েছি।মাথা পিছু আয় আজ উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, রিজার্ভের পরিমান প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার। জিডিপিতে বাংলাদেশ আজ অনেক দেশকেই অতিক্রম করে চলেছে।আজ সেই শোষক পাকিস্তানিরাই বাংলাদেশের মত অর্থনীতির দেশ হতে চায়, এমন প্রধানমন্ত্রীও চায়।

মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা, টানা এক যুগ ধরে বছরের প্রথম দিন সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়া,ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান,সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় বিধবা ভাতা, বয়স্ক ও স্বামী পরিত্যাক্তভাতা।

মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বহু পরিমাণ বৃদ্ধি করা, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াসহ নানা ধরণের সামাজিক সুরক্ষামুলক কাজ করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

কোভিড ১৯ মহামারির বিরুদ্ধে বুকচিতিয়ে লড়াই করা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখায় বিশ্ব আজ বিস্মিত। নিজেদের টাকায় স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ শেষ পর্যায়ে, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী, পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, ফোর লেনে জাতীয় মহাসড়ক ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আজ অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা চার চারবারের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুরই স্বপ্নেরই সফল বাস্তবায়ন। কিন্তু হায়,আজ শুধু পিতাই নেই!

দ্বিতীয় যে জাগয়াটি গুরুত্ব সহকারে বলতে চাই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এর ভাষণের একপর্যায়ে পিতা বলেন- "ডাঃ কামাল কে নিয়ে ৩ মাস জেরা করছে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দাও কয়েকজন বাঙালি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে তাদের আমরা জানি চিনি এবং তাদের বিচার ও হবে।" আমি আজ জাতির পিতার ৪৮তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে জাতির কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই এদের বিচার কি হয়েছে? কবে হবে?

পরিশেষে বলতে চাই ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস শুধু আনন্দের দিনই না, আবেগের দিন,অনুপ্রেরণার দিন আর অবশ্যই বাঙালি ইতিহাসের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ দিন। ১০ জানুয়ারি এসেছিল বলেই আমরা বাঙালিরা স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। বিশ্ব দেখছে শেখ মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আজ তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বীরদর্পে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যাবে ইনশাআল্লাহ ।

 

লেখক : ইমরান বিশ্বাস

সাবেক সহ সম্পাদক

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: