কাঁকন বিবি, নামটার মধ্যে কোন ভাবগাম্ভীর্য না থাকলেও, মানুষ হিসেবে ছিলেন অনুকরণীয়। স্বামী, সন্তান, পরিবার ছেড়ে যে কজন নারী অন্যের স্বপ্ন জোড়া দিতে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে একজন আমাদের কাঁকন বিবি। আসল নাম কাঁকাত হেনিনচিতা হলেও 'মুক্তিবেটি' নামে পরিচিত ছিলেন। জাতিতে ছিলেন খাসিয়া। বাঙালি না হয়েও তিনি রয়ে গেছেন প্রতিটি বাঙালির মণিকোঠায়।
বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের যে আলো জালিয়ে ছিলেন, সেই আলোর সন্ধান দেওয়া এক নারী। যে সময়ে মেয়েদের একমাত্র কাজ ছিলো সন্তান লালন পালন করা, সমাজের বোঝা মনে করা হতো সেই তিনিই সমাজ উদ্ধারে নেমে পড়লেন যুদ্ধের ময়দানে, ছেড়ে আসলেন তিন মাসের কন্যা সন্তান। অত্যাচারিত, নির্যাতিত হয়েছেন বহুবার, পাড়ি জমিয়েছেন মৃত্যু সাগরে, লক্ষ্য একটাই 'স্বাধীনতা'।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীমসাহসিকতা ও অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তিনি বীরযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, বীরমাতা, মুক্তিবেটি, মুক্তি বোর্ট এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিকন্যা প্রভৃতি নামে সমধিক পরিচিত।
শৈশব:
মিজোরাম রাজ্যের নক্রাই গ্রামে খ্রিস্টান বাবা গিসয় আর মা মেলি'র অভাবের সংসারে জন্ম। জুমচাষই সংসার চালানোর একমাত্র মাধ্যম হলেও বাবা মারা যাওয়া মরার উপর খারার ঘা হয়েই আসল কাঁকন বিবিদের পরিবারে। বাবা হারানোর কিছুদিনের পর মা মেলিও পাঁচ সন্তানকে ছেড়ে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। কাঁকনকে দেখাশোনা করার ভার তুলে নেন তারঁই বড় বোন, কাফল। বোনের বিয়ে হয়ে গেলে বোনের সাথে সাথে তাঁরও নতুন ঠিকানা হয় বাংলাদেশ।
ব্যক্তিজীবন:
জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছেন বোনের সহচার্যে। মা বলতে ছিল তার বড়ো বোনই। আর বাবার স্নেহ আদর পেয়েছেন বড়ো বোনের স্বামী খুশি কমান্ডারের কাছ থেকে। অল্পবয়সে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শহীদ আলী মতান্তরে শাহেদ আলী/সাঈদ আলী সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর নতুন নাম রাখা হয় নূরজাহান বেগম। দাম্পত্যজীবনে তাঁদের সংসারে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের আগমন ঘটে এবং নাম রাখেন সখিনা বেগম। তখনকার সময়ে মেয়ে সন্তান জন্মদেওয়া এক বড় অপরাধ। কাকন বিবি সেই অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে স্বামীর ঘর ছাড়েন। সন্তান ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন। কাছে টেনে নেন মাতৃরূপী বড় বোন। পরবর্তীতে কাঁকন বিবি আবারও বিয়ের পীড়িতে বসেন তৎকালীন ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের সাথে। সখিনা বেগমকে নিয়ে তার সংসার বেশ ভালোই চলছিলো। কিন্তু এই সুখ কপালে বেশি দিন সইলো না। হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয় মজিদ খান। স্বামীর জন্য পাগল হয়ে ঘুরতে থাকেন এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে।
যুদ্ধের সাহসিকতা:
স্বামী ইপিআর সৈনিক হওয়ায় সিলেটের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকার সুযোগ হয়ে ছিল কাঁকন বিবির। এরই মধ্যে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের দামামা। পাকিস্তানি সৈনিকেরা শুরু করে অমানসিক অত্যাচার নির্যাতন। পিতৃতুল্য খুশি কমান্ডারকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈনিকেরা। তারঁ বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করা। পিতৃতুল্য মানুষটাকে হারিয়ে কাঁকন বিবি খুবই কষ্ট পান। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর তীব্র তাগিদ অনুভব করেন। সেই তীব্র কষ্ট, জেদ থেকেই যোগ দেন মুক্তিবাহিনীর 'ইনফর্মার' হিসেবে। কাঁকন বিবি যে গ্রামে থাকতেন তার পাশেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। আবার এই ক্যাম্প থেকে খানিকটা দূরেই ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। যা স্থানীয়ভাবে টেংরা ক্যাম্প নামে পরিচিত।
সুনামগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলটি ছিল পাঁচ নম্বর সেক্টরের অধীন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল মীর শওকত আলী। মুক্তিবাহিনীর যে ক্যাম্প ছিল তার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন শহীদ মিয়া। মীর শওকত আলী এক দিন ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। তিনিই মূলত কাঁকন বিবিকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প থেকে খবর সংগ্রহের কাজে লাগানোর জন্য উৎসাহিত করেন।
কাঁকন বিবির প্রধান কাজ ছিল পাকিস্তানি ক্যাম্পে ঢুকে তাদের হাতিয়ারের ধরন, সংখ্যা ও সৈনিকদের অবস্থান সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করা। নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে একটি ময়লা ও ছেঁড়া কাপড় পরে ভিক্ষুকের বেশ ধরে রওনা দেন টেংরা ক্যাম্পের দিকে। এলাকার লোকজনদের অনেকেই তখন শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গেছে। ফলে তাকে খুব বেশি কেউ চিনতেও পারল না। প্রথমে টেংরা ক্যাম্পের বাইরে কয়েকটি বাড়িতে ভিক্ষা করেন। পরে কৌশলে একসময় ঢুকে পড়েন টেংরা ক্যাম্পের ভেতর। ভিক্ষা চান পাকিস্তানি মিলিটারিদের কাছেই। তারা কিছু ময়দা ও আটা ভিক্ষা দেয়। ভিক্ষা করার পাশাপাশি মিলিটারিদের কাছে তার স্বামী আবদুল মজিদ খানের খোঁজও করেন। নানা কায়দায় কিছুক্ষণ ক্যাম্পের ভেতর অবস্থান করে সবকিছু দেখার চেষ্টা করেন এবং প্রথম দিন তিনি খুব ভালোভাবেই তার দায়িত্ব পালন করেন। তারঁ দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হামলা করা হয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। পরাজিত হয় পাক হানাদার বাহিনী।
গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাক বাহিনীর হাতে পুনরায় ধরা পড়েন তিনি। এবারে একনাগাড়ে ৭ দিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারেরা তাকে বিবস্ত্র করে তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেওয়া হয়।
গাছে বেঁধে তাঁর উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় বর্বর পাকবাহিনী। মৃত ভেবে অজ্ঞান কাঁকন বিবিকে পাক বাহিনী ফেলে রেখে যায়। কয়েকদিন পরে জ্ঞান ফিরে আসলে তাকে উদ্ধার করে বালাট সাবসেক্টরে নিয়ে আসা হয়।
এই নির্মম ও বীভৎস নির্যাতনের পরও তাঁর মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারেনি পাকিস্তানি সৈন্যরা। সুস্থ হয়ে তিনি পুনরায় ফিরে আসেন বাংলাবাজারে। কাঁকন বিবি ‘ইনফর্মার’ হিসেবে কাজ করেন সুনামগঞ্জে অবস্থিত পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে। সেখান থেকে যান সিলেট ক্যাম্পে। পরে যান গোবিন্দগঞ্জ, জাউয়া বাজার ক্যাম্পে। সব জায়গাতেই তার একই কাজ। ক্যাম্পের অবস্থান, সৈন্য সংখ্যা, হাতিয়ার ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে আসা। চুপিসারে সকল কষ্ট, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে, কাজ করে যান দেশের টানে।
অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত হন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে। এর পরবর্তীকালে তিনি সম্মুখ যুদ্ধ আর গুপ্তচর উভয় কাজই শুরু করেন।এরপরে প্রায় ২০টি যুদ্ধে
সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাক সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। এই যুদ্ধে তার দেহে কয়েকটি গুলি বিদ্ধ হয়। শেষ জীবনেও উরুতে কয়েকটি গুলির চিহ্ন রয়ে গেয়েছিল।
শেষ জীবন:
১৯৯৭ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর আত্মত্যাগ ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করার ঘোষণা দেন এবং বসবাসের জন্য এক একর খাসজমি প্রদান করেন। পরে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে এবং আর্থিক সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে।
২০১৮ সালের ২০ মার্চ গুরুতর অসুস্থাবস্থায় তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। ২১ মার্চ বুধবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে এখানেই মৃত্যুবরণ করেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা।
কাঁকন বিবি বেঁচে ছিলেন শতবছর, মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন লক্ষ কোটি বছর।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: