বানারীপাড়ার জৌঁলুস হারিয়ে ফেলেছে দুই'শ বছরের ঐতিহ্যবাহী ধানচালের ব্যবসা

জাকির হোসেন, বানারীপাড়া (বরিশাল) | ২৯ জুলাই ২০২২, ০৬:৪৮

সংগৃহীত

বানারীপাড়ার দুই'শ বছরের ঐতিহ্যবাহী ধানচালের ব্যবসা জৌঁলুস হারিয়ে ফেলেছে। কালের পরিক্রমায় বন্ধ হওয়ার পথে এ ব্যবসা। ধান চালের বিক্রি ও প্রক্রিয়াজাতকরনের জন্য ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই বানারীপাড়া দক্ষিন অঞ্চলের অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত।

বরিশালকে বালাম চালের জন্য যে বিখ্যাত বলা হয় সেই বালাম চাল বানারীপাড়ায়ই প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। সম্প্রতি এ সুনাম সুখ্যাতিতে ভাটা পড়েছে। হাটবাজরের পরিধি সংকুচিত হয়েছে। দুর দুরন্তের ব্যবসায়ী, কৃষক ও কুঠিয়ালরা ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে নানা কারনে। যেভাবে গড়ে উঠেছিল প্রায় দুইশত বছর পূর্বে বানারীপাড়ায় ধানচালের ব্যবসার গোড়া পত্তন হয়। কালক্রমেই এর বিস্তুৃতি ঘটে। বরিশালের বালাম চালের সুনাম দেশের সর্বত্র এমনকি পাশ্ববর্তী দেশগুলোতেও। বালাম চাল বানারীপাড়ায়ই প্রক্রিয়াজাতকরন হয়। বালাম ছাড়াও অন্যান্য চালেরর চাহিদা ও সুনামের জন্য ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকার শতশত ফরিয়া এখানে এসে চাল ক্রয় করে নিয়ে যেত। সিলেট, ভৈরব, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী, সন্দ্বীপ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ভোলা, ঝিনাইদহ, যশোর প্রভৃতি স্থনের ব্যবসায়ীরা তাদের এলাকায় উৎপন্ন ধানের প্রচুর চাহিদার কারনে ধানবিক্রি করতে বানারীাড়ায় আসত। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধানচালের ব্যবসার উপর বানারীপাড়ার অন্যান্য ব্যবসা নির্ভরশীল। বানারীপাাড়ায় নব্বই দশকের শেষ অবধি ৫ সহস্রাধিক পরিবার কুটিয়ালী পেশার উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্ভর করত।

এ উপজেলায় ৭০ ভাগ মানুষ একসময় এ ব্যবসার সাথে কোননা কোন ভাবে জড়িত ছিল। অত্র অঞ্চলে চাল উৎপাদনকারীদের স্থানীয় ভাষায় কুঠিয়াল বলা হয়। কুঠিয়ালদের সংখ্যা একসময় ছিল প্রায় ২৫ হাজার। উপজেলায় শতাধিক রাইচ মিল ছিল। বানারীপাড়ায় ধানচালের হাট বসে শনি ও মঙ্গলবার। তবে রবি ও বুধবারেও ধান চাল বেচাকেনা হয়। সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় ভাসমান হাটে মুলত ধানচাল বিক্রি হয়। একসময় বানারীপাড়া বন্দর বাজার, পশ্চিমপাড় দান্ডয়াট,থেকে শুরো করে রায়েরহাট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার জুরে নদীতে ভাসমান অবস্থায় হাজার হাজার নৌকায় ধান চালের হাট বসত।

বর্তমানে বানারীপাড়ার লঞ্চঘাট সংলগ্ন সন্ধ্যা নদীতে ভাসমান চালের হাটটি এবং নদীর পশ্চিমপাড় দান্ডহাটে ভাসমান ধানের হাটটি বসে। কিন্তু রবি ও বুধবারের হাটকে বলা হয় গালার হাট। উপজেলার নলেশ্রী, দিদিহার, দান্ডয়াট, বাইশারী, মসজিদবাড়ী, আউয়ার, কালিরবাজার, খোদবখ্শ, মলঙ্গা, চাখার, বাকপুর, ঝিরারকাঠী, ভৈৎসর, চালিতাবাড়ী, চাউলাকাঠী, কাজলাহার, ব্রাক্ষনকাঠী, জম্বদীপ, নাজিরপুরসহ আশপাশের এলাকায় শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ এ কাজে জড়িত ছিল। হাট থেকে ধান কিনে বাড়িতে নিয়ে নারী-পুরুষ সকলের সম্মিলিত শ্রমে তা প্রক্রিয়াজাত করে চাল তৈরী করে পরবর্তী সেই ভাসমান হাটে বিক্রি করা হয়। এক সময় তাদেরকে স্থানীয় মহাজনদের হাতে শোষিত ও বঞ্চিত হতে হতো।

কুঠিয়াল বিদ্রোহঃ ১৯৮৯ -৯০ সালে এ নিয়ে মহাজনদের সাথে ব্যাপক সংঘাত বাধে যা নিয়ে আন্দোলন হয়। যার প্রভাব পড়ে ধান চালের হাটের উপর। মহাজনদের সাথে কুটিয়ালদের দীর্ঘস্থায়ী বিরোধে সাধারন ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বিভিন্ন জেলা উপজেলা সদরে হাটবাজার গড়ে উঠে। যাতে করে গত একদশকে কুটিয়াল পরিবারের সংখ্যা ৫ হাজার থেকে কমে ১ হাজারে নেমে আসে।

বর্তমান অবস্থা এবং কিছু কারনঃ গত ১৪/১৫ বছর ধরে বানারীপাড়ায় ধানচালের ব্যবসা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচেছ। বেশির ভাগ কুঠিয়াল তাদের মূলধন খুইয়ে ফেলেছে। অনেকেই নৌকা বিক্রি করে দিয়েছে। আড়ৎদাররা তাদের ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হচেছ। বানারীপাড়ার আড়ৎদার পট্টির বহুঘর এখন ভাড়াটিয়া বিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। এ ব্যবসার সংঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রায় ৭০-৮০ হাজার লোক এখন অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছে।

বানারীপাড়ার সুপ্রাচীন এ ব্যবসা বন্ধ হওয়ার কারন সম্পর্কে জানা যায় যেসব স্থান থেকে অতীতে ব্যবসায়ীরা আসত ধানচাল কেনা বেচার জন্য সেসব স্থানে মোকাম গড়ে উঠেছে এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাল উৎপাদন হওয়ায় খরচ অনেক কম হয়। সেকারনেই ব্যবসায়ীরা দলে দলে এখন আর বানারীপাড়ায় আসছে না। প্রায় একই অভিমত ব্যক্তকরেছেন অনেক ব্যবসায়ী।

এ প্রসঙ্গে একজন চাল কমিশন ব্যবসায়ী অভিযোগের শুরে বলেছেন বিগত কয়েক বছর যাবত অধিক মুনফা অর্জনের জন্য কুঠিয়ালরা চালকে অত্যন্ত নরম করে ছাটাই করে এতে ওজন অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া দুর অঞ্চল থেকে চাল বহন খরচ, কমিশন ,নিরব চাঁদাবাজী, অতিরিক্ত টোল আদায়, অসাধু ব্যবসায়ীদের জালিয়াতি ইত্যাদির ব্যয়ভার বহন করার পর আশানরূপ মুনফা অর্জিত হয়না বলে এখন আর ব্যবসায়ীরা বানারীপাাড়ায় আসছে না। এছাড়া আধুনিকতার ছোঁয়ায় পূর্ব পুরুষদের এ ব্যবসাকে নিম্নমানের ও কষ্ট সাধ্য মনে করে অনেকেই অন্য পোশার দিকে ঝুঁকছে। ফলে একসময়ের ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসা আজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: