বৃষ্টিস্নাত সিলেট ও আমাদের গল্প

আসিফ আজাদ, রাবি | ২১ জুলাই ২০২২, ১০:৩৪

সংগৃহীত

চারিদিকে থৈ থৈ পানি, সাথে নির্মল বাতাস আর আকাশে রূপালী মেঘ। এমন দারুণ পরিবেশেও ক্রমাগত কাঁপুনি দিয়ে ঘামছে অশেকা। গায়ে নীল রঙা লাইফ জ্যাকেট, তার উপর হলুদ পলিথিন জড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে আছে সে। কাঁপুনির সাথে সাথে ক্রমাগত দোয়া-ই ইউনূস পড়ে যাচ্ছে। এই বুঝি ডুবে মারা যাবে! শুনে মনে হতে পারে এ বুঝি ডুবন্ত টাইটানিকের কোনো যাত্রীর শেষ যাত্রার গল্প। তবে না, এটা টাইটানিকের কোনো যাত্রীর কথা নয়। সিলেট ভ্রমণে গিয়ে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে নৌকায় বসে আমাদের বান্ধবী অশেকার করা নানান কার্যকলাপের একটি মাত্র। আচ্ছা, তাহলে একদম শুরু থেকে শুরু করি।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতির রঙিন ক্যানভাসকে বর্ণিল রঙে রাঙিয়ে তুলতে বন্ধুদের নিয়ে একটি ভ্রমণের পরিকল্পনা ছিল বহু আগে থেকেই। সেদিন রমজানের এক পড়ন্ত বিকেলে স্রোতস্বিনী পদ্মার তীরে বসে ইফতারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ অর্পণ বলে উঠলো, 'পরীক্ষা যেহেতু শেষ চল ঈদের পর একটা ট্যুর দিয়ে আসি।' 

ইরফান বললো, 'কিন্তু যাব কোথায়?' কে যেন হঠাৎ বলে উঠলো, সিলেট হলে মন্দ হয় না। যেমন বলা, তেমন কাজ। ঈদের ছুটির মাঝেই সমস্ত পরিকল্পনা হয়ে গেল।

ঈদ শেষ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭ মে সকালে অমর্ত্য, আহাদ, লোচন, কনকের রাজশাহী থেকে ঢাকা যাত্রা। আমি আর ইরফান আগে থেকেই ঢাকায় ছিলাম। অর্পণও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে উপস্থিত। ঢাকা থেকে আমাদের সিলেটগামী ট্রেন রাত সাড়ে আটটায়। আটটার মধ্যেই আমরা ছয়জন মিলিত হলাম কমলাপুর রেলস্টেশনে। আহাদ যুক্ত হলো বিমানবন্দর স্টেশন থেকে। শুরু হয়ে গেলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আমাদের ৮ বন্ধুর সিলেট ভ্রমণ। তবে বাড়িতে থাকার কারণে ভৈরব স্টেশন থেকে আমাদের সাথে যুক্ত হয় অশেকা। 

যে উচ্ছ্বাস নিয়ে ট্যুরের পরিকল্পনা করেছিলাম তাতে কিছুটা ভাটা পড়ে যাত্রা পথে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির দুঃসংবাদ শুনে। চলতে থাকে বিস্তর আলোচনা- সিলেটে নামবো নাকি শ্রীমঙ্গল। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো সিলেটে-ই যাব। নানা শঙ্কার মধ্যেই ভোরের আলোয় আমাদের ট্রেন সিলেট স্টেশনে প্রবেশ করল। সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে জানালা, দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু স্টেশনে পৌঁছানোর পর আমাদের সেই শঙ্কা, উৎকণ্ঠা সব কেটে গেলো। সকলের চোখে মুখে দেখা গেলো আনন্দের হাসি। লোক মুখে যেমন শুনছিলাম স্টেশন ডুবে আছে, বাস্তবে তেমন দেখতে পেলাম না।

ট্রেন থেকে নেমে সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম দরগার মোড়। সেখানে ব্যাগ দেখাশোনার দায়িত্ব পড়লো অশেকা, লোচন এবং আমার উপর। অমর্ত্য, ইরফান, আহাদ, অর্পণ এবং কনক চলে গেলো হোটেলের খোঁজে। আধা ঘন্টার মধ্যেই হোটেল পাওয়া গেল। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম সিলেটের বিখ্যাত পাঁচ ভাই হোটেলের জন্যে; উদ্দেশ্য সকালের নাশতা। 

নাশতার পর্ব শেষ। এবারের গন্তব্য রাতারগুল। পথের দু'ধারের মনোরম দৃশ্য যেন সম্মোহিত করে ফেললো আমাদের। গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলতে লাগলাম সবাই। ছবির পালা শেষে আবারও যাত্রা। প্রায় দেড় ঘণ্টার রাস্তা শেষে আমরা রাতারগুল ঘাটে পৌঁছালাম। মেঘলা আকাশ, চারিদিক পানিতে টইটম্বুর আর হু-হু বাতাস। অসাধারণ এই দৃশ্য নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা ভার। 

আমরা যেহেতু আটজন ছিলাম তাই দুটো নৌকার টিকিট কাটলাম। সাথে সবার জন্য লাইফ জ্যাকেট। আর বৃষ্টির জন্য চারটি ছাতা। ঘাট থেকে নৌকার যাত্রা শুরু হলো। এক নৌকায় আমি, ইরফান, কনক ও অশেকা। অপর নৌকায় আহাদ, অমর্ত্য, অর্পণ আর লোচন। আমাদের মধ্যে শুধু অমর্ত্য আর ইরফান সাঁতার জানে। সে কারণে তাদের দুজনকে দুই নৌকায় নেওয়া। যাত্রা পথে যতদূর চোখ যাচ্ছিলো শুধু পানি আর পানি, সাথে ঘন কালো মেঘ। পানি আর মেঘের এ মিতালি ক্যামেরা বন্দি করতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তবে সবার মাঝে ব্যতিক্রম একজন; বান্ধবী অশেকা। নৌকায় গুটিশুটি হয়ে লাইফ জ্যাকেট, পলিথিন গায়ে জড়িয়ে দোয়া কালাম পড়ায় ব্যস্ত সে। আমাদের নৌকার মাঝি লিচু মিয়া। সেখানকার সব থেকে অভিজ্ঞ মাঝি। তারপরও যেনো অশেকার স্বস্তি মেলেনা। তবে মাঝির সাথে গল্পের এক পর্যায়ে জানতে পাড়লাম তার একটি ইউটিউব চ্যালেন আছে, নাম ‘লিচু মিয়া রাতারগুল’। 

এসবের মাঝেই নৌকা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতে থাকে। একটু পর পর দেখা মিলে অর্ধনিমজ্জিত সুবিশাল গাছের সারি। মাথার উপর গাছের ডালপালাগুলো সবুজের দুর্ভেদ্য জাল তৈরি করে রেখেছে। তার মধ্য দিয়ে চলছে আমাদের নৌকা। রাতারগুলের এ অপরূপ দৃশ্য সচরাচর দেখা মেলা ভার। বন্যার কারণে এবার রাতারগুল এ মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে বলে জানালেন আমাদের মাঝি ভাই। 

যাত্রা পথের মাতাল হাওয়া, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর মাঝি ভাইয়ের গানের সাথে আমাদের গলা মেলানো- স্নিগ্ধ রাতারগুলের এ মূহুর্তগুলো যেন স্মৃতির ক্যানভাসে এক রংধনু হয়ে রয়ে গেল।

রাতারগুল ভ্রমণ শেষে রওনা হলাম জাফলংয়ের উদ্দেশ্যে। প্রায় দুই ঘণ্টার পথ। রাস্তার দু’ধারে অথৈ পানি আর সীমারেখায় সাড়ি সাড়ি পাহাড়। জাফলংয়ের যত নিকটে যাচ্ছিলাম ততই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি হাত বাড়ালেই পাহাড় ছুঁতে পারবো। কিন্তু গাড়ি এগোতে থাকলেও পাহাড়ের দূরত্ব যেন কমেই না। এসময় সঞ্জিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ ভ্রমণকাহিনীর সেই কথাটি মনে হলো- ‘পর্বত সমন্ধে দূরত্ব স্থির করা বাঙালির পক্ষে বড় কঠিন’।

সুবিশাল পাহাড়ের সৌন্দর্যে মোহিত হলেও হৃদয়ে এক বেদনা দানা বাঁধতে লাগলো। সারি সারি পাহাড়গুলোর একটিও আমার দেশের সীমানায় না, সবকটিই ভারতের ভূসীমায় অবস্থিত। অন্য দেশ থেকেই যে পাহাড় দেখে এমন লাগছে; না জানি এদেশে হলে কি নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারতাম তা! এই বেদনাকে সঙ্গী করেই এগিয়ে যেতে লাগলাম জাফলংয়ের উদ্দেশ্যে।

আনুমানিক দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা জাফলং পৌঁছালাম। সেখানে একটি হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে নৌকা ঠিক করে ‘মায়াবী ঝর্ণা’র উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমরা। চারপাশ দেখে মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি যেন তার রূপ-লাবণ্য উজাড় করে দিয়ে চেয়ে রয়েছে ভ্রমণ পিপাসুদের দিকে। নৌকা থেকে আমরা প্রকৃতির সেই অপার মহিমা উপভোগ করতে লাগলাম।

সামনে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। বিশাল বিশাল সব পাহাড়। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে একে বেঁকে চলে গেছে সরু রাস্তা। সেখানে দুই পাহাড়ের সংযোগ ঘটিয়েছে ঝুলন্ত ‘ডাউকি’ ব্রিজ। তার উপর দিয়ে চলছে গাড়ি। এসব দেখে মনে হচ্ছিল, ইস্! যদি মেঘালয়ে ঘুরে আসতে পারতাম। ডাউকি যেতে না পারলেও নয়নাভিরাম এই প্রাকৃতির মাঝ দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল আমাদের ছোট্ট নৌকা। কিন্তু বন্যার কারণে নদীর পানিতে আমাদের গোসল হলো না। 

কিছুদূর যেতেই হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসলো ঝর্ণার শব্দ। রোমাঞ্চ আর উত্তেজানায় সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নৌকা থেকে নেমে দুই মিনিট হাঁটাতেই দেখা মিললো মায়াবী ঝর্ণার। বর্ষার কারণে ঝর্ণায় প্রচুর পানি ছিল। আমরা পাঁচ বন্ধু গিয়েই পানিতে ছুটাছুটি শুরু। তবে এ ক্ষেত্রে অমর্ত্য ভয় ডর হীন ভাবে পাথর বেয়ে ঝর্ণার উপরে উঠে গেলো। দেখে মনে হচ্ছিল যেন পাহাড়ি ঝর্ণার সাথে তার কত দিনের মিতালি। আর অমর্ত্যরে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র ছিল অশেকা। সে ভয়ে এখানে পানিতে নামেনি। একা একা দাঁড়িয়ে আমাদের ব্যাগ পাহারা দিচ্ছিল। এরই মধ্যে আবার শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টি যেনো ঝর্ণার সৌন্দর্যকে কয়েক হাজার গুণ বাড়িয়ে দিল। বৃষ্টি, ঝর্ণা, মেঘ, বাতাস আর চারিদিকে পাহাড় সব মিলিয়ে যেন কল্পনার রাজ্যকে হার মানাবে জাফলংয়ের এই পরিবেশ। 

বিকাল ৫ টার পর আমরা ফিরে আসার জন্য নৌকায় উঠলাম। নৌকা থেকে নেমে পথের ধারে বিভিন্ন দোকান থেকে সবাই টুকটাক কেনাকাটা করল। দূর থেকে পাহাড়ের বুক চিরে বেরিয়ে আসা ঝর্ণা দেখতে দেখতে আমরা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। রাত সাড়ে আটটার দিকে আমরা হোটেলে পৌঁছালাম। এরপর ফ্রেশ হয়ে মাজারে প্রবেশ করলাম। সেখানে এত কবুতর আর বড় বড় গজার মাছ, যা সত্যিই অবাক করার মত। 

এরপর আমরা সিএনজি এবং রিকশা ঠিক করে রাতের খাবারের জন্য হোটেল পানসিতে গেলাম। সেখানে খাবার খেয়ে সিলেট শহর দেখার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। সিএনজি নিয়ে গেলাম ক্কীন ব্রিজে। এরার পত্রিকা, টেলিভিশন সহ বিভিন্ন মানুষের কাছে যে বন্যার খোঁজ পেয়েছিলাম তার বাস্তর প্রমাণ পেলাম। সুরমা নদী পানিতে টইটম্বুর এবং এর আশে পাশে যেসব ঘরবাড়ি রয়েছে সেগুলো ডুবে গেছে। ব্রিজের নিচে একদম ছুঁই ছুঁই পানি। সবাই চা খেলাম আর আশে পাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করলাম। এরই মধ্যে বৃষ্টি নামলো। আর শহর ঘুরে দেখা হলো না। হোটেলে ফিরতে হলো। এভাবেই সমাপ্তি ঘটলো আমাদের সিলেট ভ্রমণের প্রথম অধ্যায়ের। এর পরের গন্তব্য ছিল শ্রীমঙ্গল। তবে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের লোমহর্ষক সব গল্প জমা রইলো আরেকদিন জন্য।

আসিফ আজাদ সিয়াম

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: