পরীমণিকে গ্রেফতারে প্রথম স্বামী ও গ্রামবাসীর মন্তব্য

সময় ট্রিবিউন | ৬ আগষ্ট ২০২১, ০৮:৫০

মাঝের ছবি: পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়ায় পরীমণির অর্থে নির্মাণ করে দেওয়া নানাবাড়ি।

গ্রেফতারের পর আলোচনায় রয়েছেন ‘ডানাকাটা পরী’ শামসুন্নাহার স্মৃতির গল্প। ১৯৯২ সালে নড়াইলে জন্ম নেওয়া স্মৃতি খুব ছোটবেলায় মা এবং পরে বাবাকে হারিয়ে বড় হন পিরোজপুরে নানার কাছে। সেখান থেকেই মাধ্যমিক শেষে ২০১২ সালে আসেন ঢাকায়। নাচ শেখেন। পরে মডেলিং থেকে ছোট পর্দায় আবির্ভাব, টিভি নাটকে অভিনয়। শামসুন্নাহার নাম বদলে হয়ে ওঠেন পরী মণি। এরপর রূপালী পর্দায় আসা। শামসুন্নাহার স্মৃতি হয়ে উঠেন পরীমনি ।

তাকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় সিংহখালীতেও। এখানে নানাবাড়িতেই শৈশব কেটেছে পরীমণির।

স্থানীয়দের অনেকেই এ ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন, পরীমণি ছোটবেলা থেকেই কোমল স্বভাবের। চলছে নানা জল্পনাও। নানাবাড়ির লোকেরা বলছেন, পরীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে।

সালমা বেগম ও মনিরুল ইসলাম দম্পতির একমাত্র সন্তান পরীমণি। জন্মের তিন বছর বয়সে মাকে হারান তিনি। বাবা মারা গেছেন ২০১২ সালে। বাবা–মা নাম রেখেছিলেন শামসুন্নাহার স্মৃতি। ডাকনাম স্মৃতিমনি। ঢাকায় শোবিজের ঝলমলে জগতে এসে নাম ধারণ করেন পরীমণি। স্মৃতিমনির শৈশবজুড়ে পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার সিংহখালীর নানাবাড়ি। নানা শামসুল হক গাজী কোলেপিঠে বড় করেছেন তাঁকে। নানা প্রথমে তাকে ভর্তি করান পার্শ্ববর্তী মঠবাড়িয়া উপজেলার মিরুখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ সিংহখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ভর্তি করান ভগিরাতপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। এসএসসি পাস করে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় পাড়ি জমান স্মৃতিমনি।

সিংহখালী নানাবাড়িতে এখন থাকেন পরীমণির ছোট খালা তাসীলমা বেগম ও তাঁর স্বামী জসিম উদ্দিন। পরীমণি সময় পেলেই ছুটে যান শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত নানাবাড়িতে। এলাকার সাধারণ মানুষদের চোখের সামনে বেড়ে ওঠা শামছুননাহার স্মৃতি যে একদিন সারা দেশে এমন আলোচনায় আসবে তা কি কেউ ভেবেছিল! তাই এ নিয়ে অনেকের চোখে বিস্ময়! পাশাপাশি চলছে নানা গুঞ্জন, কানাঘুষা।

ছোট খালা তাসলিমা বেগম বলছেন, সবকিছুই চক্রান্ত। জনপ্রিয়তার কারণে পরিকল্পনা করে পরীমণিকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান তিনি।

এলাকার বাসিন্দা নুরজাহান বেগম বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে শামছুননাহার স্মৃতিকে দেখেছি, সে ওই রকম মেয়েই নয়। তার আচরণ অনেক শান্ত স্বভাবের। এমন ঘটনা আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন।

আরেক বাসিন্দা রেহেনা বেগম বলেন, এই এলাকার স্কুলেই পরী পড়াশোনা করেছে। কখনো এমনটা মনে হয়নি। তাঁর নানা ভগিরাতপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। তিনি অনেক ভালো মানুষ। পরিবারের প্রায় সবাই শিক্ষক। ভালো পরিবারের মেয়ে পরী, সে কখনো এমনটা করতে পারে এটা মানতে পারছি না।

পরীমণির ছোট খালা তাসলিমা বেগম বলেন, হঠাৎ করে চলচ্চিত্র জগতে বেশি জনপ্রিয়তাই পরীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এর আগেও দেখেছি, বিভিন্ন সময়ে পরীকে বাধ্য করা হয়েছে। নাসির উদ্দিন নামে একজন বড় ব্যবসায়ী বিভিন্ন সময়ে ওর ক্ষতি করতে চেয়েছিল। পরীর সঙ্গে যা ঘটেছে সেটি চক্রান্ত মনে হচ্ছে। এর আগেও ওকে বাধ্য করা হয়েছিল। মেরেও ফেলতে চেয়েছিল। আমরা এই ঘটনার পেছনে যারা আছেন, তাঁদের সম্পর্কে জানতে চাই। পরী সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমরা পরীর মুক্তি চাই।

পরীমনির ছোট খালু শিক্ষক জসিম উদ্দিন বলেন, ছোটবেলা থেকে নানাই তাঁকে পড়াশোনা করিয়েছেন। আমরা কেউই চাইনি সে এই জগতে আসুক, হয়তো তার প্রতিভা ছিল। প্রতিভার কারণেই আজ তাঁর এই অবস্থা হয়েছে। নানাভাইয়ের প্রতি সে অনেক দুর্বল। যেখানে নানাভাই থাকে, সেখানে এমনটা আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হোক।

তবে এদিকে পরিমনির গ্রেফতারের জন্য বেখেয়ালি জীবনযাপনকে দায়ী করলেন তার প্রথম স্বামী সৌরভ। তার দাবি, পরীমনির একাধিক বিয়ে হলেও তাদের তালাক হয়নি এখনো।
ফেরদৌস কবীর সৌরভ কেশবপুর পৌরসভার সাবেক নারী কাউন্সিলর শাহানা কবির ফতেমার ছোট ছেলে। দুই বছর প্রেমের পর ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনিকে বিয়ে করেন তিনি।
ওই সময় পরী ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্রী। সৌরভ ওই বছর এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে ঢাকার বিজেএমসি ক্লাবে ফুটবল খেলার ডাক পান। তখন স্ত্রী স্মৃতিকে নিয়ে রাজধানীতে পাড়ি জমান। ঢাকার বনশ্রীতে বাসা ভাড়া নিয়ে স্ত্রীকে মিরপুরের একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করেন।
সেখানে থাকার এক পর্যায়ে মিডিয়ায় জড়িত এক ব্যক্তির নজরে পড়েন স্মৃতি। তাদের মধ্যে পরিচয়ের একপর্যায়ে তার বিভিন্ন স্টাইলের ছবি তুলে পত্রিকায় ছেপে তাকে মডেল ও নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখান সেই ব্যক্তি। এরপর শামসুন্নাহার স্মৃতি নাম পাল্টে নানির 'পরীবানু' থেকে পরীর সঙ্গে মনি যোগ করে পরীমনি করেন তিনি।
সৌরভ গণমাধ্যমে বলেন, পত্রিকায় ছবি ছাপার কিছুদিনের মধ্যে উশৃঙ্খল জীবনযাপন শুরু করেন পরীমনি। যে কারণে স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে সৌরভের। একদিন মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত সেই ব্যক্তিকে পরীমনি বিয়ে করেছেন বলে জানতে পারেন সৌরভ। এরপর ঢাকা ছেড়ে কেশবপুরে ফিরে আসেন তিনি।
কেশবপুরে এসে ফুটবল ছেড়ে হাতে তুলে নেন গিটার। এক সময় তিনি পরিচিতি পান শিল্পী সৌরভ কবির হিসেবে। তার বন্ধুরা তাকে টেনে নেন আওয়ামী রাজনীতিতে। বর্তমান পৌরসভার ছাত্রলীগ নেতা হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে তার।
সৌরভ আরও জানান, মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর পরীমনি সৌরভকে তাদের কেশবপুরের বহুতল বাড়িটি বিক্রি করে ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনার জন্য উৎসাহিত করেন। ওই সময় সৌরভ ঢাকায় বিজিএমসি ফুটবল টিমের খেলোয়াড়। এক পর্যায়ে তারা কেশবপুরের বাড়িটি বিক্রি করে দেন। ওই সময় পরীমনির উশৃঙ্খল চলাফেরা শুরুর কারণে তারা ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। এটা নিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে।
এরই মধ্যে স্মৃতি পরীমনি হয়ে মিডিয়া জগতে পরিচিতি পেয়ে যান। ফলে ২০১৫ সালে সৌরভ কেশবপুরে ফিরে আসেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালে পরীমনির সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে কথা হয়।
এদিকে, মাদকের মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনিকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ এই আদেশ দেন।
গতকাল বনানীতে পরীমনির বাসায় অভিযান চালিয়ে তাঁকে আটক করে র্যাব। পরে রাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার নজরুল ইসলাম রাজকে আটক করা হয়।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: