সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৯৫ তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে মিশেল ইয়ো সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার পেয়েছেন। অস্কার পাওয়া প্রথম এশিয়ান নারী তিনি।
২০২২ এ মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘Everything Everwhere All at Once’-এ অভিনয় করে প্রশংসিত হন। এই সিনেমায় তার পারফরম্যান্সের জন্যই অস্কার পান ইয়ো।
মিশেল ইয়ো, যিনি মিশেল খান নামেও পরিচিত, তার আসল নাম ইয়ো চু খেং। ১৯৬২ সালের ৬ আগস্ট মালয়েশিয়ার ইপোহতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মালয়েশিয়ার অ্যাকশন সিনেমার সেরা অভিনেত্রীদের মধ্যে একজন। বডি ডাবলের সাহায্য না নিয়ে একাই মারাত্মক সব স্টান্ট পারফর্ম করেন। শুধু স্টান্টই না, এর পাশাপাশি তার অভিনয়ও সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে।
শৈশব ও কৈশোর
ইয়ো এর জন্ম মালয়েশিয়ার একটি পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই বাস্কেটবল ও সাঁতারসহ নানারকম শারীরিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। ব্যালে নাচের প্রতিও তার বিশেষ অনুরাগ ছিল তার। কিশোর বয়সে লন্ডনের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ ডান্সে ভর্তি হন। কিন্তু পিঠের ইনজুরির কারণে ব্যালে ডান্সার হওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যায়।
পরবর্তীতে একটি ব্যালে স্কুল খোলার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু ১৯৮৩ সালে মিস মালয়েশিয়া প্যাজেন্ট বা প্রতিযোগিতায় ইয়ো এর মা তার নাম দেন। ইয়ো এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন।
এই বিজয় ইয়ো এর ক্যারিয়ার পুরোপুরি বদলে দেয়। তিনি বিশ্বখ্যাত অভিনেতা জ্যাকি চ্যানের সাথে একটি বিজ্ঞাপনে কাজ করার সুযোগ পান। বিজ্ঞাপনটি দেখে হংকং এর একটি প্রযোজনা কোম্পানি ইয়ো এর সাথে যোগাযোগ করেন। ইয়ো তাদের সাথে অভিনয়ের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ওই কোম্পানিটিই তাকে স্টেজ নেম হিসেবে ‘মিশেল খান’ নামটি ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়।
হংকং-এর চলচ্চিত্র তারকা
১৯৮৪ সালে মাও তু ইং ইউ শাও ফে শিয়াং (The Owl vs. Bombo) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক হয় ইয়োর। এই সিনেমায় একজন প্রেমিকার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্য তার নজর কাড়ে। দৃশ্যগুলির কোরিওগ্রাফি ও ছন্দ তাকে আবারো নাচের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ইয়ো’র মনে হয় তিনিও স্টান্ট করতে চান। তখনই কঠোর প্রশিক্ষণ শুরু করেন। স্টান্ট করতে এসে তার আগের নাচের দক্ষতা কাজে লাগে। তিনি শারীরিকভাবে ফ্লেক্সিবল ছিলেন, তাছাড়া দ্রুত শিখতে পারতেন। তার ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতাও ছিল প্রবল।
১৯৮৫ সালে মার্শাল আর্ট সিনেমা ‘হুয়াং জিয়া শিজিয়ে’তে (Yes, Madam!) তিনি অভিনয় করেন। দুইজন নারী পুলিশ অফিসারকে ঘিরে এই সিনেমার গল্প তৈরি হয়। এটি ‘Girls with Guns’ ঘরানার শুরুর দিকের ছবি ছিল। এরপর বেশ কিছু অ্যাকশন সিনেমা করেন ইয়ো।
১৯৮৮ সালে তিনি প্রযোজক ডিকিনসন পুনকে বিয়ে করে সিনেমা জগত থেকে অবসর নেন। ১৯৯২ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের পর ইয়ো আবার চলচ্চিত্রের জগতে ফিরে আসেন।
১৯৯২ সালে ইয়ো ‘Police Story 3: Super Cop’ (যা Super Cop নামেও পরিচিত) সিনেমায় অভিনয় করেন। এই অ্যাকশন-কমেডি সিনেমাটিতে বেশ কিছু অসাধারণ স্টান্ট ছিল। একটি জনপ্রিয় দৃশ্যে ইয়োকে একটি দ্রুতগতির ভ্যানের পাশে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। একটা বাস এলে তিনি লাফ দিয়ে ভ্যানটির ছাদে উঠে যান, পেছনের দিকে রোল করে ছাদ থেকে একটি গাড়ির ছাদে পড়ে যান।
এটি ও Super Cop 2 সহ বেশ কিছু সিনেমা তাকে হংকং এর নামকরা তারকা করে তোলে। ইয়ো এর স্টান্টে তার নির্ভুলতা ও ভয়হীনতা দেখা যায়।
তবে এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্টান্ট করতে গিয়ে ইয়ো বেশ কয়েকবার মারাত্মক ইনজুরির সম্মুখীন হন। যেমন ১৯৯৫ সালে The Stunt Woman এর শ্যুটিং এর সময় তার মেরুদণ্ড প্রায় ভেঙে গিয়েছিল।
ইনজুরি থেকে সুস্থ হওয়ার সময় তিনি একবার অবসর নেয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু আমেরিকান পরিচালক কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনো, যিনি ইয়োর ভক্ত ছিলেন, তাকে অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেন।
বৈশ্বিক খ্যাতি ও পরবর্তী সিনেমাসমূহ
১৯৯৭ সালে জেমস বন্ড সিনেমা ‘Tomorrow Never Dies’ এ একজন চায়নিজ এজেন্টের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি সারা বিশ্বের দর্শকদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। গতানুগতিক ‘বন্ড গার্ল’ থেকে আলাদা তার চরিত্র একজন গোয়েন্দার মতোই বিচক্ষণ ও অনন্য ছিল। এই সিনেমাটিতে ইয়ো তার স্টান্ট না, বরং অভিনয়ের জন্যই কাজ করার সুযোগ পান।
তবে অ্যাং লি এর ‘উয়ো হু কাং লং’ (Crouching Tiger, Hidden Dragon) সিনেমার মাধ্যমে তিনি বিশ্বের দর্শকদের কাছে তারকা হয়ে ওঠেন। বহুল প্রশংসিত এই সিনেমা যোদ্ধা ইউ শু লিয়েন (ইয়ো) ও মার্শাল আর্ট মাস্টার লি মু বাই (চাউ ইউন-ফ্যাট) এর মধ্যে মনোমুগ্ধকর প্রেমের কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে। প্রেমের কাহিনীর পাশাপাশি এই সিনেমায় দারুণ কিছু অ্যাকশন দৃশ্যের দেখা মেলে। এই সিনেমাটি এত জনপ্রিয় হয় যে বক্স অফিসে বিপুল সাড়া জাগায়, এমনকি বেশ কয়েকটি ক্যাটেগরিতে অস্কারও জেতে।
পরবর্তীতে ইংরেজি ভাষার বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করেন ইয়ো। ২০০৫ সালে ‘Memoirs Of A Geisha’ নাটকে দেখা যায় তাকে। তার তিন বছর পর অ্যাকশন অ্যাডভেঞ্চার সিনেমা ‘The Mummy: Tomb of the Dragon Emperor’-এ প্রাচীন যাদুকরের চরিত্রে অচিনয় করেন।
একজন অভিনেত্রী হিসেবে নিজের পরিসর দর্শকদের সামনে প্রতিনিয়ত তুলে ধরছিলেন তিনি।
২০২২ এ 'Everything Everwhere All at Once' এর জন্য ব্যাপক প্রশংসা পান তিনি। এটিই ছিল প্রথম হলিউডি সিনেমা যেখানে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সাই-ফাই কমেডিতে তিনি একজন লন্ড্রোমার্ট মালিক ছিলেন, যার হাতে এই মাল্টিভার্সকে বাঁচানোর দায়িত্ব ছিল। এই সিনেমায় তাকে একই চরিত্রের নানারকম ভার্সনে অভিনয় করতে হয়েছিল। এর মধ্যে একটি ভার্সন ছিল মার্শাল আর্টে দক্ষ নায়িকা। এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ইয়ো প্রথম এশিয়ান অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার জয় করেন। পাশাপাশি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডও পান।
অনন্য অভিনয় প্রতিভা ও বিপুল তারকাখ্যাতি থাকা সত্ত্বেও, একজন এশিয়ান নারী হওয়ার কারণে মিশেলকে নানা বাধার মধ্যে পড়তে হয়েছে। হলিউড তাকে শুরুতেই গ্রহণ করেনি। গত বছর ‘Everything Everwhere All at Once’ এর জন্য ইয়ো যখন একের পর এক অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছিলেন, তখনই হলিউড তাকে মাল্টিভার্সে চুক্তিবদ্ধ করে।
কমেডি বা মিউজিক্যাল এ সেরা অভিনেত্রী ক্যাটাগরিতে গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর ইয়ো হলিউড সম্পর্কে তার অনুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি বলে, "আমি যখন প্রথম হলিউডে আসি, বিষয়টা একটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ছিল। তবে এখানে আসার পর আমাকে বলা হয়, আমি সংখ্যালঘু। আমি বললাম যে না, এটা সম্ভব না।”
এশিয়ান হিসেবে তাকে কত বৈচিত্র্যপূর্ণ আচরণ পেতে হয়েছে সে গল্প করতে গিয়ে ইয়ো বলেন, “একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি ইংরেজি বলতে পারেন? আমি বলেছি, হ্যাঁ, ১৩ ঘণ্টার ফ্লাইটে এখানে এসেছি, পথে আসতে আসতে শিখে নিয়েছি।"
প্রথম এশিয়ান নারী হিসেবে মিশেল ইয়ো’র অস্কার প্রাপ্তি এশিয়ান নারীদের স্বপ্ন দেখার পথ আরো বিস্তৃত করে দিয়েছে। অস্কার গ্রহণের সময় ইয়ো এই বিষয়ে বলেন, “আমার মত দেখতে (এশিয়ান) ছোট ছেলে মেয়েরা যারা আজকে আমাকে দেখছো, এটা (অস্কার) আশা ও সম্ভাবনার আলো। এটা প্রমাণ যে, বড় স্বপ্ন দেখো, স্বপ্ন সত্যি হয়।”
আমাদের সমাজে মনে করা হয় নারীরা ৩০ এর পরে আর কিছু করতে পারবেন না। ২০২৩ এ মিশেলের বয়স যখন ৬০ বছর, অস্কার পুরস্কার জিতে তিনি এ কথাটিই নারীদের স্মরণ করিয়ে দেন, “লেডিজ, কাউকে এ কথা বলতে দেবেন না যে, আপনি কোনো কিছু হয়ে ওঠার সময় পেরিয়ে এসেছেন।”
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: