ইগো ছাড়ুন; কাজকে ভালোবাসুন

আরাফাত আব্দুল্লাহ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় | ২৬ নভেম্বর ২০২২, ০৮:১০

প্রতীকী ছবি

 

ঠিক এই মূহুর্তে আমি যে পরিমাণ টাকা ইনকাম করি (বলা ভালো যে টাকাটা আল্লাহ আমাকে রিজিক হিসেবে দেন) আজকে থেকে ঠিক ৩ বছর আগেও আমি চিন্তা করতে পারি নাই সেই টাকাটা আমার হাত দিয়ে ইনকাম করিয়ে নেয়া হবে কিংবা আমার রিজিক এইভাবে লেখা আছে। মহাখালী আর বনশ্রীর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই আমার চোখ ছলছল করে উঠতো নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। মাথায় চিন্তা নিয়ে আমি আবার সিভিতে মন দিতাম। কি কি ভুল আছে, আর কি কি যোগ করা যেতে পারে, আমাকে কোথাও ডাকলে কিভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করবো ইত্যাদি নানা বিষয়ে মাথা ঘামাতাম ।

সবচেয়ে করুণ ঘটনার মুখোমুখি হলাম একদিন। এমন এক কোম্পানীতে নিজ হাতে সিভির হার্ড কপি দিতে গেলাম যেখানে গেস্টদের ওয়েটিং রুমে সিকিউরিটিরা পা তুলে ঘুমায়। এসি তো দূরে থাক, একটা ফ্যান কোন রকমে মাথার উপর কট কট শব্দ করে ঘুরে। মনে হচ্ছে এই আমার মতোই একটু পর মাটির উপর ধসে পড়বে। সোফায় বসলে এক গাদা ধুলো উড়ে। সোফার ছেড়া ফোমের আড়ালে যেন নিজের ভবিষ্যৎ দেখে নিয়েছিলাম সেদিন। এর মধ্যেই এইচআরের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনার কোম্পানীতে একটা জব অপেনিং ছিল। সিভি নিয়ে আসছি। আপনার কাছে দেবো?

উনি চশমার আড়ালে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি সিভিটা ওই কোনার বাস্কেটে রাখুন। অন্যরা সেখানে রেখেছে।

মলম বিক্রির কোম্পানীতেও কেউ এইভাবে সিভি দেয় কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু সেইদিন নিজের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে বাস্কেটের মধ্যে আমার সিভিটা রেখেছিলাম । অফিস থেকে বেরিয়েই আমার মনটা হাহাকার করে উঠলো। হাত দিয়ে চোখ মুছি। কিন্তু কাজ হয় না। জীবনে কোনদিন ভাবি নাই এরকম জায়গায় আমাকে ভাইভা দিয়ে বেড়াতে হবে। নিজেকে নিয়ে আমার প্রত্যাশা আরো বড় ।

যাই হোক রিটেনে পাস দিয়ে ভাইভার সময় যখন গেলাম তখন কোম্পানির কিউসি ম্যানেজার বলল, দেখুন আপনি পাবলিক ভার্সিটি থেকে এসেছেন। আমাদের এখানে এপ্ল্যিক্যান্টের অভাব নাই। আপনাকে বেশি বেতন দিতে পারবো না। আর বেতন ১০ তারিখের আগে পারেন না। সম্মত হলে জয়েন করুন ।

দেরিতে বেতনের কথা শুনে আমি আর এগোলাম না। তবে ঐদিন ভাইভাতে আমার সাথে আরেকজন ভদ্রলোকও ছিলেন। দেশের সেরা ক্যাম্পাসের ছাত্র। অনেক বড় একটা কোম্পানীতে এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদে ছিলেন। খুব অল্প সময়ে ক্যারিয়ারের সেরা হাইটে উঠে গিয়েছিলেন। কোন এক ঘটনায় কোম্পানী তাকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছে। সেখানে তার বেতন ছিল আনুমানিক ৭০ হাজার টাকা। আর এখন ঘুরছেন ২০ হাজার টাকার চাকুরীর পেছনে। এই একটা ঘটনাই আমার চোখটা খুলে দিলো। নিজের মধ্যে আমি যে ইগোটা রেখেছিলাম সেটা বিসর্জন দিলাম। আমার থেকেও খারাপ অবস্থায় মানুষ আছে। মলম কোম্পানী হোক আর মাল্টিন্যাশানাল ক্যোম্পানী হোক, সব জায়গায় নিজের সেরাটা দিবো আমি। আল্লাহর দুনিয়াতে প্রতিটা হালাল কাজই ভালো। বেতন যাই হোক না কেন।

আমি মাইক্রোবায়োলজির ছাত্র। পেশাও এই লাইনেই। এমন কোম্পানীতেও আমি জব করে আসছি যেখানে টানা ২২ রাত আমি শুধু নাইট ডিউটি করে গেছি। শুক্র,শনি কোন ছুটি নাই। এমন অনেক দিন গেছে রাত দশটায় ডিউটি করতে ঢুকেছি, পরদিন সকাল নয়টায় বের হয়েছি। স্যাম্পল কালেকশন, ডকুমেন্টেশন, টেস্ট একাই করতাম। উপায় ছিল না। তবে দিন শেষে বেতন খুব আহামরি ছিল তা নয়। হাসি মুখেই মেনে নিয়েছি। যখন জবটা ছেড়ে আরেক জায়গায় সুইচ করলাম তখন প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা পর্যন্ত দিলো না আমাকে।

এরপর বিগত ৩ বছরে আমি জব চেঞ্জ করলাম ৩ টা (নতুন একটা কোম্পানীতে এই মাসেই জয়েন করতে যাচ্ছি)। প্রতিটা জায়গায় আমার বেতন বাড়লো ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা করে, যেটা ৩ বছর আগেও আমি চিন্তা করি নাই। এখন সারাদিন এসির বাতাসে থাকি। নিজের কম্পিউটার, ডেস্ক সবই আছে। গাড়ি বাসার সামনে থেকে এসে নিয়ে যায়, আবার বাসার সামনে নামিয়ে দেয় ।

আপনারা যারা জব খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না, কিংবা ইতোমধ্যে নিজের ভবিষ্যৎকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন অনুগ্রহ করে তারা একটু ধৈর্য ধরেন। আপনার থেকেও বেশি বিপদে পরা লোকজন আছে। আপনার থেকেও ভালো রেজাল্ট নিয়ে প্রচুর ছেলেমেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। ফ্যাক্ট চেক করে দেখুন ,শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের শুরুটা অবশ্যই তাদের মন মতো ছিল না ।

ইগো ছাড়ুন। অনেকেই আছে মায়ের আঁচলের নিচে বড় হয়েছে। জব করতে তাদের অনেক শর্ত। ঢাকার বাইরে যাবে না। এতো টাকা বেতন না দিলে হবে না। বাস্তবতা হচ্ছে এটাই যে একটা ওয়েল এস্টাব্লিশড মলম কোম্পানীও আপনাকে ছাড়াই এতো দিন চলেছে। ভবিষ্যতেও চলবে। অতএব আপনাকে কেউ ক্যাম্পাস ভাঙ্গিয়ে পায়ে ধরে চাকুরী দেবে এই আশা করা নিতান্ত বোকামী। বাস্তবতা হলো আপনি ২০ হাজার টাকায় যে জব করতে রাজি আছেন, সেই একই জব ১৫ হাজার টাকায় করার মতো মাস্টার্স পাশ দেয়া ছেলের অভাব নাই।

প্রতিটা কোম্পানীকে (যারা হালাল জিনিস উৎপাদন করে) সম্মান করুন। হতে পারে সেটা মলম কোম্পানী। হতে পারে মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানী। হতে পারে তার বেতন ১০ হাজার টাকা। হতে পারে তার বেতন ১০ লক্ষ টাকা। চাকুরী করেন বা না করেন, আপনাকে ডেকেছে সেজন্য মন থেকে হলেও একটা ধন্যবাদ দিন। তারা হয়তো আপনাকে পছন্দ মতো বেতন দিতে পারে নাই। কিন্তু একটা অভিজ্ঞতা তো দিয়েছে।

রেজাল্ট যদি খারাপ হয়েই থাকে তাহলে এটার জন্য আলাদা মাশুল দেয়ার প্রস্তুতি নিন। নিশ্চিত থাকুন আপনার ভাইভা সবার থেকে আলাদা হবে। হতে বাধ্য। এমন অনেক জায়গা থাকবে যেখানে আপনি সিভি দিলেও ডাক পাবেন না। দায়টা নিজের কাধে নিন। সেটার উপর কাজ করুন। রেজাল্ট অবশ্যই একটা ফ্যাক্ট। মনে রাখুন রেজাল্ট খারাপ করার মধ্যে আর যাই হোক কোন ক্রেডিট নাই।

সরকারী জব হইতেই হবে, নতুবা ভাত খামুনা টাইপের অথর্ব ইমোশোন বাদ দেন। হলে খুবই ভালো। না হলে বিকল্প ব্যবস্থা রাখুন। দিন শেষে নিজের পরিবারটাকে অসহায় করে দিয়েন না। আপনার এইসকল বোধহীন ইমোশনের জন্য পরিবারের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।

রিজিকের যিনি মালিক, তার উপর ভরসা করেন। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আপনার মেধা, আপনার রেজাল্ট, আপনার ক্যাম্পাস এগুলো দিয়ে রিজিক আসে না। রিজিক আসে আল্লাহর তরফ থেকে।

Arafat Abdullah, CU

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: