আজ ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দীর্ঘদিন পর মাকে দেখার জন্য আকুল হয়ে ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বাড়ি ফিরছিল কিশোরী ইয়াসমিন। কিন্তু দিনাজপুরের কোচে না উঠতে পেরে সে পঞ্চগড়গামী একটি কোচে ওঠায় কোচের লোকজন তাকে দিনাজপুরের দশমাইল নামক স্থানে নামিয়ে দিয়ে সেখানকার এক চায়ের দোকানে জিম্মায় দেয়।
নিরাপদ ও রক্ষক ভেবে ইয়াসমিনকে দিনাজপুর শহরে মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাকডাকা ভোরে পুলিশের হাতে তুলে দেয় দশমাইলের লোকজন। কিন্তু রক্ষক হয়ে পুলিশ ভক্ষক সেজে পথিমধ্যে কিশোরী ইয়াসমিনকে পালাক্রমে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে। এর পর পুলিশ ইয়াসমিনের লাশ দিনাজপুর শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুর সদর উপজেলার ব্র্যাক অফিসের পাশে রাস্তায় ফেলে চলে যায়।
পরের দিন পুলিশের এই পৈশাচিক ঘটনা জানাজানি হলে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। কিন্তু তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে উল্টো কিশোরী ইয়াসমিনকে পতিতা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন দিনাজপুরের প্রতিবাদী জনতা। বিক্ষোভে ফেটে পড়েন দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
২৬ আগস্ট রাতে বিক্ষুব্ধ জনতা কোতোয়ালি থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে থাকলে পুলিশ আবারও তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এ সময় হাজার হাজার জনতা কোতোয়ালি থানার সীমানাপ্রাচীর ভেঙে ফেলেন। ২৭ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতা একে একে রাজপথে নেমে এসে সব প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলি এবং দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবিতে জনতার বিশাল মিছিল বের হলে মারমুখী পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালায়। ফলে সামু, কাদের ও সিরাজসহ নাম না জানা সাতজন নিহত হন। আহত হন তিন শতাধিক।
পরে বিক্ষুব্ধ জনগণ শহরের চারটি পুলিশ ফাঁড়ি জ্বালিয়ে দেন। বিক্ষোভের এই সুযোগ নিয়ে কতিপয় স্বার্থান্বেষী ও দুষ্কৃতকারী দিনাজপুর প্রেসক্লাব, দৈনিক উত্তরবাংলাসহ স্থানীয় ৫টি পত্রিকা অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দিনাজপুর শহরে জারি করা হয় কারফিউ। টানা তিন দিন চলে কারফিউ। তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেবসহ শহরের গোটা পুলিশ সদস্যদের ক্লোজড করা হলে শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে তৎকালীন বিডিআর। পরে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক জব্বার ফারুককেও প্রত্যাহার করা হয়।
এ ঘটনায় তৎকালীন দিনাজপুর সিআইডি জোনের সিনিয়র এএসপি আফজাল হোসেন বাদী হয়ে পুলিশের এএসআই ময়নুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পিকআপ ভ্যানচালক কনস্টেবল অমৃত লালকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। ওই মামলাটি পুলিশের সিনিয়র এএসপি মাহফুজুর রহমান তদন্ত করে এজাহারনামীয় তিনজন আসামি এএসআই ময়নুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার, পিকআপ ভ্যানচালক কনস্টেবল অমৃত লাল, তৎকালীন দিনাজপুরের পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেব, কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি এসআই মাহতাব উদ্দীন, এএসআই স্বপন কুমার, এসআই মতিয়ার রহমান, এএসআই জাহাঙ্গীর আলম ও ময়নাতদন্তকারী ডা. মহসিনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করেন।
প্রথম পোস্টমর্টেমে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া না গেলেও আন্দোলনের মুখে দ্বিতীয়বারের জন্য মরদেহ উত্তোলন করা হয়। নিরাপত্তাজনিত কারণে ইয়াসমিন হত্যা মামলাটি দিনাজপুর থেকে স্থানান্তর করা হয় রংপুরে। রংপুর বিশেষ আদালতে ১৯৯৭ সালে ইয়াসমিন হত্যা মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় এএসআই ময়নুল ইসলাম, পুলিশ কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পিকআপ ড্রাইভার অমৃত লাল বর্মণের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে এই মামলা মাথায় নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০৪ সালে বেইজিং গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে যোগ দিতে। ইয়াসমিনের পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণ ও হত্যা প্রসঙ্গ সেখানেও আলোচিত হয় এবং তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। অবশেষে ২০০৪ সালে রংপুর কারাগারে তিন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: