থানা বিএনপি'র সাবেক সেক্রেটারিকে নৌকার মনোনয়ন দেওয়ার পায়তারা; তৃণমূলে ক্ষোভ

সময় ট্রিবিউন | ৮ অক্টোবর ২০২১, ০৯:১৪

প্রতীকী ছবি

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়ন নির্বাচন ঘিরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ফতুল্লা থানা বিএনপি'র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুল আলম সেন্টু আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক চেয়ে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এর আগে অনেক নাটকীয়তার পরে ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগ নৌকার প্রার্থী হিসেবে শুধু সেন্টুর নাম সুপারিশ করে কেন্দ্রে পাঠায়। কুতুবপুরে নৌকা চেয়ে কমপক্ষে ৬জন প্রার্থী মনোনয়ন ফরম কিনে মাঠে থাকলেও প্রভাবশালী মহলের চাপে তারা মনোনয়ন ফরম জমা দেননি।

একাধিক সূত্রমতে, প্রভাবশালী মহলের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়েই নৌকার প্রার্থী হতে আগ্রহীরা মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। ৮০' এর দশকে যুবদলের রাজনীতি দিয়ে মনিরুল আলম সেন্টু পরিচিতি পান। থানা যুবদলের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। সেন্টুর বিরুদ্ধে ওই সময়ের প্রভাবশালী ছাত্রলীগ নেতা শফিকুর রহমান মেছের হত্যা, পাগলার যুবলীগ নেতা রিপন হত্যা, সরকারবিরোধী নাশকতা, জ্বালাও-পোড়াওসহ কমপক্ষে ০৮টি মামলা রয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে কুতুবপুরের শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বাড়ি দখল ও লুটপাট চালায় সেন্টু বাহিনী। বিএনপি শাসনামলে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের নিজ কার্যালয়ে ধরে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

সূত্র জানায়, সেন্টু ২০০৩ সালে ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ওই বছরেই অনুষ্ঠিত হওয়া ইউপি নির্বাচনে বিএনপি'র সমর্থনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তখন কুতুবপুরে প্রবেশ করতে পারতো না। ফলে সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হন সেন্টু। ২০০৪ সালে ফতুল্লায় বিএনপি'র বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে এসে বিশাল শোডাউন করেন তিনি।

২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতায় আবারও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সেন্টু। ওই সময়ে সেন্টুর বিরুদ্ধে ডামি প্রার্থী দেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে সেন্টু ধানের শীষ প্রতীক চেয়ে জেলাজুড়ে পোস্টার-ফেস্টুন সাঁটান। কিন্তু পরবর্তীতে তৎকালীন জেলা বিএনপি'র সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকার সেন্টুকে ডেকে নিয়ে ধানের শীষ প্রতীক দিতে চাইলেও সেন্টু তা নেননি। প্রভাবশালী মহলের পরামর্শে সেন্টু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। ছয় কোটি টাকা ও একটি দামি গাড়ি প্রভাবশালী মহলকে দিয়ে সেন্টু জয় নিশ্চিত করেছেন, এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। গুঞ্জনের সত্যতাও মেলে। খোদ নৌকার প্রার্থী, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সহসভাপতি সিকদার মোঃ গোলাম রসুল জেলা প্রশাসকের সাথে প্রার্থীদের বৈঠকে তাকে প্রচারণা চালাতে বাধা দেওয়া ও হুমকি প্রদানের অভিযোগ করেন। নির্বাচনের দিনও নৌকার পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া ও ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। জেলার অন্যান্য ইউপিতে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে প্রভাবশালী মহল তৎপরতা দেখালেও কুতুবপুরে ছিল ভিন্ন চিত্র। ফলে পরাজয় বরণ করতে হয় নৌকাকে।

বহুল আলোচিত কুতুবপুরের নির্বাচনে নৌকার পরাজয় নিয়ে পরবর্তীতে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলে ওই সময়ে দৈনিক সমকালসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে উঠে আসে। কুতুবপুরে উল্টোধারার রাজনীতি নিয়ে জেলাজুড়েও সমালোচনা কম হয়নি।

এবারের নির্বাচনেও একই খেলা খেলছে প্রভাবশালী মহল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে অবস্থিত একটি পার্ক থেকে ইতোমধ্যে সেন্টুকে গ্রীন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়। আর সেই সিগন্যালকে পাকাপোক্ত করতে কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সেন্টুর মামাতো ভাই জসিমকে দিয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ব্যানারে বর্ধিত সভার আয়োজন করা হয়। গুঞ্জন রয়েছে, ওই সভার যাবতীয় খরচ সেন্টু বহন করেছেন। সভায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেশ কড়া ভাষায় বক্তব্য দিয়ে দলের করুণ অবস্থা তুলে ধরেন। আগ্রহী প্রার্থীরাও নিজেদের ইচ্ছের কথা জানান দেন। ৮জন প্রার্থীর নামও লিখিত আকারে নেওয়া হয়, যেখানে সেন্টুর নাম ছিল না। কিন্তু জসিমের কৌশলে থানা কমিটির কাছে সেন্টুকে নৌকার একমাত্র প্রার্থী হিসেবে সুপারিশ করে জমা দেওয়া হয়।

সূত্রমতে, নৌকার প্রার্থী হিসেবে সেন্টুর মনোনয়ন ফরম কিনতে ও জমা দিতে গতকাল ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে যান জসিম, আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমসহ আরো কয়েকজন। তারা ইতোমধ্যে তা জমাও দিয়েছেন। মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান শিকদার মোঃ গোলাম রসুলও।

সেন্টু প্রসঙ্গে থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী বলেন, 'সেন্টু বিএনপি'র বহিস্কৃত নেতা। তবে তিনি আওয়ামী লীগেও যোগ দেননি। যা রটেছে, তার কিছু তো বটে। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আমাদের কাছে তার নাম সুপারিশ করেছে। তিনি যদি নৌকা চান, তখন আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নিবো।'

ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন অবশ্য দাবি করেছেন যে সেন্টু আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। তবে তিনি এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। জসিম বলেন, 'নেতাকর্মীরা সেন্টুর নাম থানা কমিটিতে পাঠিয়েছে।'

বৃহত্তর ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফতুল্লা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম রাহাত বলেন, 'সেন্টুর নাম প্রস্তাব করা নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভ রয়েছে। অনেকেই ভয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছে না। একজন বহিস্কৃত বিএনপি নেতা, যিনি কিনা আমাদের দলের কর্মীও নন, তিনি কীভাবে নৌকা পান! এমন কিছু হলে কুতুবপুরে আর আওয়ামী লীগের অস্তিত্বই থাকবে কিনা তা নিয়ে আমি সন্দিহান। অনেক নেতাকর্মী ইতোমধ্যে দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।

এদিকে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সেন্টু ধানের শীষের মনোনয়ন ফরম কেনেন। বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিক দলের পদধারী নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপি'র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ধানের শীষ নিয়ে শোডাউনও করেন। তার সেইসব ছবি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনেও ধানের শীষ প্রতীক চেয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালান সেন্টু।

এছাড়াও ২০১৭ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার টেকনাফ অভিমুখী লংমার্চকে স্বাগত জানানোর ছবি, প্রয়াত বিএনপি নেতা হান্নান শাহের সাথে মোনাজাতরত ছবি, খালেদা জিয়ার সমাবেশে তার যোগদানের ছবি এখন জেলার অন্যতম আলোচনার বিষয়। প্রসঙ্গত, সরকারবিরোধী নাশকতা, জ্বালাও পোড়াও মামলায় অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ায় ২০১৫ সালে সেন্টুকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: