বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বাঁধা প্রদানকারীদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি সরকারি ও বিরোধী-দুই পক্ষের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
তিনি বলেছেন, নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে বিরোধী পক্ষ সহিংসতা করলে তারাও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। যারা এ কাজের আদেশ দেবেন এবং যারা বাস্তবায়ন করবেন তারা উভয়ই ভিসার জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
বুধবার রাতে চ্যানেল আইয়ের তৃতীয়মাত্রায় সাংবাদিক জিল্লুর রহমানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা জানিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারবিবরণী ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তাদের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করেছে।
জিল্লুর রহমান: যুক্তরাষ্ট্র সরকার কেন বাংলাদেশিদের জন্য এই নতুন ভিসানীতি চালু করতে যাচ্ছে? এটি কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল?
ডোনাল্ড লু: ‘আমি একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, আজ আমরা কারও বিরুদ্ধে স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দিইনি। আপনি যেমনটা বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন আজ একটি নতুন নীতি ঘোষণা করেছেন, যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেসব ব্যক্তির ভিসা সুবিধায় বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে, বিশেষ করে যারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সুতরাং যে কেউ এর আওতায় পড়তে পারেন, সরকারের লোকজন, বিচার বিভাগের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বিরোধী দলের কেউ।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়া এবং সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র রক্ষার বিষয়টি একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য।
জিল্লুর রহমান: দেশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অন্য বাংলাদেশিদের কীভাবে এই নীতির আওতায় আনা হবে? আপনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা উল্লেখ করেছেন-সরকারের কোনো সদস্য কি এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত?
ডোনাল্ড লু : এই নীতিটি সরকারের এবং বিরোধী দলের সদস্য উভয়ের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, সামনের নির্বাচনে যদি আমরা দেখি যে বিরোধী দলের কেউ সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছেন বা ভোটারদের ভয় দেখিয়েছেন, তাহলে সেই ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। একইভাবে যদি আমরা দেখি যে সরকারের কোনো সদস্য বা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কেউ ভোটারদের ভয় দেখিয়েছেন বা সহিংসতায় জড়িত অথবা বাক স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করেছেন, তবে সেই ব্যক্তিকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের অনুমতি দেব না।
জিল্লুর রহমান: জড়িত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও কি ভিসা বিধিনিষেধ নীতির আওতায় পড়বেন?
ডোনাল্ড লু : এর জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ। নতুন এই নীতি এবং যে আইনের ওপর ভিত্তি করে এটি নেওয়া হয়েছে-উভয় জায়গাতেই এ বিষয়টি খুব স্পষ্ট। অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যরা, অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তানরাও এই নীতিতে ভিসা বিধিনিষেধের সম্মুখীন হবেন।
জিল্লুর রহমান : যাদের ভিসা বাতিল করা হয়েছে, তাদেরকে কি আপনারা জানাবেন?
ডোনাল্ড লু : ঠিক তাই। যাদের ভিসা বাতিল করা হবে, তাদর সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি জানানো হবে।
জিল্লুর রহমান : সুনির্দিষ্টভাবে কাদের এই বিধিনিষেধের আওতায় আনা হবে?
ডোনাল্ড লু: আবারও বলছি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন কেবল একটি নতুন ভিসানীতির ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা এখনো নির্দিষ্ট কারও ওপর এ নীতি প্রয়োগ করিনি। এই নীতি আমাদের এ রকম, যে কোনো ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপে সহায়তা করবে, যারা এই চারটি কাজের যে কোনো একটিতে জড়িত থাকবেন-ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, ভোট কারচুপি, বাক স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা বা সমাবেশ করার অধিকারকে অগ্রাহ্য করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত করতে সহিংসতার ব্যবহার।
আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, সরকার ও বিরোধীদের উভয়ের ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষভাবে, গঠনমূলক পদ্ধতিতে এবং সমানভাবে এই নীতির বাস্তবায়ন করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার নির্বাচনে কখনো কোনো পক্ষ নেয় না। আমরা বিশেষ কোনো দল বা প্রার্থীকে সমর্থন করি না। যুক্তরাষ্ট্র সরকার কেবল একটি বিষয় সমর্থন করে, সেটি হলো অবাধ ও নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
জিল্লুর রহমান: যারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ বাস্তবায়ন করে থাকেন, তাদের ওপর এই নীতি প্রযোজ্য কি না?
ডোনাল্ড লু : এ বিধিনিষেধ যারা আদেশ দেবেন এবং যারা আদেশ পালন করবেন-উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য হবে। যারা আদেশ গ্রহণ করে সহিংসতা বা ভোটারদের ভয়ভীতি বা ভোট কারচুপির কাজ করবে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। একইভাবে যারা এসব কাজের নির্দেশ দেবেন, তারাও যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের অনুমতি পাবেন না।
জিল্লুর রহমান: গত ১৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তা (ট্রাফিক এসকর্ট) কমিয়ে আনার পালটা পদক্ষেপ হিসাবেই কি এই নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে?
ডোনাল্ড লু: বিষয়টি একেবারেই তেমন না। গত ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে যখন নতুন এই নীতির বিষয়ে আগাম অবহিত করা হয়েছিল, তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সুতরাং ৩ মের নতুন এই নীতি এবং এর ঘোষণা কোনোভাবেই সরকারের ১৪ মের ঘটনার পালটা পদক্ষেপ নয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার কখনো পালটা ব্যবস্থার ভিত্তিতে কখনো সিদ্ধান্ত নেয় না এবং নেবে না।
জিল্লুর রহমান : অতীতের কতদূর পর্যন্ত নতুন এই নীতি কার্যকর হবে?
ডোনাল্ড লু : এটি একটি ভবিষ্যৎমুখী নীতি। আমাদের আশা, এ নীতি সহিংসতা প্রতিহত করতে সহায়ক হবে এবং বাংলাদেশে আগামী দিনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করবে। আমরা এই দায়িত্বটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকি এবং আমরা পেছনে ফিরে তাকাতে চাই না। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বাংলাদেশের বন্ধু মনে করে।
আমরা নতুন এই নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তার সরকার, বাংলাদেশি নাগরিক সমাজ ও বাংলাদেশের জনগণের যে চেষ্টা, তাকে বেগবান করতে চাই-এটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
জিল্লুর রহমান : বাংলাদেশের নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
ডোনাল্ড লু : বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আমাদের কাছে এই দেশটির বিশেষ স্থান রয়েছে। এই দুই দেশের মানুষে মানুষে, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কম্পানি পর্যায়ে দারুণ সম্পর্ক রয়েছে। আমরা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এগিয়ে নিতে চেষ্টা করি। এটি বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের গণতন্ত্র রয়েছে। এ কারণেই এখানে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার।
ডোনাল্ড লু আরও বলেন, আমি জানি, নতুন এই নীতিকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন উঠবে। আমি আবারও জোর দিয়ে বলতে চাই, আমরা এই সিদ্ধান্তটি সবচেয়ে গঠনমূলক এবং ইতিবাচক উপায়ে নিয়েছি। আমরা চাই, এটি বাংলাদেশে সংলাপ এবং আগামী বছরে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ-সবার প্রচেষ্টায় অবদান রাখবে।
তিনি বলেন, সামনের সময়টি বাংলাদেশের জন্য কঠিন হতে পারে। অথবা এই সময়টি সত্যিই একটি আনন্দময় যুগের সূচনা করতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ তার সব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অর্জন উদযাপন করবে, এমন একটি নির্বাচন করে, যা আগের সব নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে। এটাই আমাদের আশা।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: