এক যুগ ধরে শিকলবাঁধা জীবন কাটাচ্ছে শেরপুরের মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোরী আল্পনা আক্তার (২০)। যে বয়সে নূপুরের ছন্দ তুলে ছুটে বেড়ানোর কথা সেই বয়সে তাকে শিকলে বেঁধে রেখেছে তার পরিবার।
তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার গুরুচরণ দুধনই গ্রামের আল্পনা। বয়স তখন আট বছর। কিন্তু হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর তাকে বিভিন্ন যায়গায় চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দারিদ্র্যতার কারণে চিকিৎসা কার্যক্রম চালাতে পারেনি তার পরিবার। তাই স্কুলে আর যাওয়া হয়ে উঠে নি আল্পনার। তখন থেকেই তার জীবন কাটছে শিকলে বাঁধা অবস্থায়।
এভাবেই ১২ বছর ধরে শৃঙ্খলিত জীবন চলছে আল্পনা আক্তারের (২০)। আল্পনার বাবা শেরপুরের ঝিনাইগাতীর কাংশা ইউনিয়নের গুরুচরন দুধনই গ্রামের ছিদ্দিক আলী ওরফে চাক্কু মিয়া একজন ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ। তিনিও অসুস্থ। থাকার ঘর পর্যন্ত ছিল না তাদের। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া একটি ঘর পেয়েছেন তিনি। সেই ঘরের একটি কক্ষেই শিকলে বেঁধে রাখা হয় আল্পনাকে।
মা আছিয়া অন্যের বাড়ি থেকে সাহায্য এনে সন্তানদের নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন অনেক কষ্টে। ঘরে বন্দী থাকার পরও অনেক সময় শিকলসহ বেরিয়ে আসে আল্পনা। তখন স্থানীয়দের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয়। তাকে নিয়ে তার পরিবারও অনেক বিব্রতকর অবস্থায় আছে। অথচ সঠিক চিকিৎসা দিলে ভালো হতে পারে আল্পনা। ফিরে আসতে পারে স্বাভাবিক জীবনে।
আল্পনার বাবা ছিদ্দিক আলীর এক ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে আল্পনা তৃতীয়। ২০০১ সালে আল্পনার জন্ম হয়। ২০০৮ সালে ঢাকায় বোনের বাসায় বেড়াতে যায় আল্পনা। সেখানে হঠাৎ করেই জ্বরাক্রান্ত হয়য়। এরপর থেকেই মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া এই মেয়ের। চিকিৎসা করালেও তেমন কোনো ফল মেলেনি, বরং বাড়তেই থাকে অসুখ। শেষে ২০০৯ সাল থেকে শিকলে বেঁধে করে রাখে পরিবার।
আল্পনার বাবা সিদ্দিক আলী বলেন, ‘আমি আমার মেয়েডারে চিকিৎসা করাইতে অনেক টেহা খরচ করছি। এখন আর টেহা নাই। মেয়ের চিকিৎসার খরচ জোগাইতে আমি ১০ শতাংশ জমি, পাঁচটা গরু বিক্রি করেছি। ২০ হাজার টেহা ঋণও করেছি। আমার ইচ্ছা থাকার পরও টেহার অভাবে মেয়েকে বালা কোনো ডাক্তার দেহাতে পারতাছি না। ’
আল্পনার মা আছিয়া বেগম বলেন, ‘সরকার আমাদের এডা ঘর দিছে। ওই ঘরের এডা রুমে আল্পনা থাকে। এহন পর্যন্ত আমার মেয়ে কোনো প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড পায়নি। আমার মেয়ের যন্ত্রণায় আমি শান্তিমতো খাইতে পারি না, রান্নাও করতে পারি না। অতিষ্ঠ করে ফেলেছে আমারে। এহন কি করমু ভাইবা পারতাছি না।’
গুরুচরন দুধনই গ্রামের মেম্বার হযরত আলী বলেন, ‘আমি অনেক দিন থেকে মেয়েটিকে শিকলে বন্দী অবস্থায় দেখছি। আগে ভালো ছিল। চিকিৎসা ঠিকমতো করায়নি, করালে হয়তো মেয়েটা সুস্থ হতো।’ আমরা এলাকাবাসী কিছু টাকা উঠাইয়া দিছিলাম ওই টাকা দিয়ে তো কিছুই হয়না ই। এ এলাকাটি গরিব, তাই মানুষও টাকা দিতে পারছে না। আমরা চাই সরকারিভাবে এ মেয়েটির চিকিৎসা করানো হোক।’
ওই গ্রামের উসমান গণি বলেন, ‘শুনলাম আল্পনা মেয়েটা একদিন ঢাকায় গেল। সেখানে জ্বর নিয়ে আবার বাড়িতে আসার পর থেকেই মানসিক সমস্যা শুরু হয়েছে। তার বাবা কয়দিন চিকিৎসা করালো কিন্তু ভালো হয়নি। এ জন্য শিকলে বেঁধে রেখেছে। সঠিকমতো চিকিৎসা পেলে হয়তো ভালো হয়ে সুস্থ জীবনে ফিরত।’
ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম ওয়ারেজ নাঈম বলেন, ‘আমরা আল্পনার পরিবারের কথা শুনে সরকার থেকে একটি দুর্যোগ সহনীয় ঘর দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী ভাতা এখনো পায়নি। আমরা শিগগিরই আল্পনার জন্য মাসে মাসে ভাতার ব্যবস্থা করে দিবো। এছাড়া তার চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জায়গায় কথা বলব। আল্লাহর রহমতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে সে। আমরা সার্বিকভাবে আল্পনা ও তার পরিবারের পাশে আছি এবং থাকব ইনশাআল্লাহ্।’
শেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. এ কে এম আনোয়ারুর রউফ বলেন, ‘আমরা আল্পনার কথা সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানলাম। শেকলে বন্দি করে রাখা এটা অমানবিক কাজ। মানসিক সমস্যার চিকিৎসা তো আছে। আমরা যোগাযোগ করে ওই মেয়েকে বিনা খরচে চিকিৎসা করাবো।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: