আজ ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কতিপয় পুলিশ সদস্য কর্তৃক ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয় কিশোরী ইয়াসমিন। এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামলে জনতার উপর গুলি চালায় পুলিশ। গুলিতে নিহত হন সাত জন। আহত হন অনেকে। সেই থেকে দিনটি ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন হয়ে আসছে।
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট। ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী বাসে উঠেছিলেন ১৮ বছরের তরুণী ইয়াসমিন আক্তার। গন্তব্য দিনাজপুর শহর। ভোরে হাছনা এন্টারপ্রাইজের সে নাইট কোচের সুপারভাইজার ইয়াসমিনকে নামিয়ে দিয়েছিলেন দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার দশমাইল মোড়ে। তিনি মোড়ের এক চায়ের দোকানদারকে বলে দিয়েছিলেন, সকাল হলে ইয়াসমিনকে যেন তুলে দেয়া হয় দিনাজপুর শহরগামী বাসে।
সুপারভাইজারের কথামতো চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন ইয়াসমিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হয় রাতে টহল দেয়া পুলিশের একটি পিকআপভ্যান। তাতে থাকা পুলিশ সদস্যরা ইয়াসমিনকে নানা প্রশ্ন করেন। এর একপর্যায়ে তরুণীকে শহরে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে ভ্যানে তুলে নেন তারা।
সে ভ্যানে ওঠাই কাল হয় ইয়াসমিনের। পুলিশ সদস্যরা দশমাইল এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। তারা তরুণীর মরদেহ ফেলে রেখে যায় দিনাজপুর শহরের রানীগঞ্জ মোড়ে ব্র্যাক কার্যালয়ের সামনের রাস্তায়।
বেলা বাড়তেই জানাজানি হয় ঘটনা। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুর। সড়কে নেমে আসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সভা-সমাবেশ করে তারা দাবি জানায় দোষীদের কঠোর শাস্তির।
ঘটনার দুই দিন পর ২৬ আগস্ট রাতে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানা ঘেরাও করে প্রতিবাদী হাজারো জনতা। প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ২৭ আগস্ট সকালেও। দুপুরে জড়িতদের শাস্তি দাবিতে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিতে যাওয়া মানুষের মিছিলে ঢেকে যায় সড়ক। মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ; নিহত হন সামু, কাদের, সিরাজসহ সাতজন। আহত হন তিন শতাধিক মানুষ। পুরোপুরি ভেঙে পড়ে শহরের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শহরে জারি হয় ১৪৪ ধারা; নামানো হয় তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। একযোগে প্রত্যাহার করা হয় দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ ১৩ উপজেলার সব পুলিশ সদস্যকে।
এর দুই বছর পর ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রায় আসে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার। রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন পুলিশের এএসআই মঈনুল হক, কনস্টেবল আবদুস সাত্তার ও পিকআপভ্যানের চালক অমৃত লাল বর্মণকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।
আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগে এএসআই মঈনুলকে আরও পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন বিচারক। তার দেয়া সে রায় কার্যকর হয় আট বছর পর। রংপুর জেলা কারাগারে ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় এএসআই মঈনুল, কনস্টেবল আবদুস সাত্তারের। ২৯ সেপ্টেম্বর ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় পিকআপ ভ্যানের চালক অমৃত লাল বর্মণকে।
এ দণ্ড কার্যকরে ক্ষোভ কিছুটা হলেও প্রশমন হয় ইয়াসমিনের পরিবারের, কিন্তু আক্ষেপ রয়ে যায় আহতদের। ইয়াসমিন হত্যার এত বছর পরও কেউ খোঁজ রাখে না বলে অভিযোগ তাদের।
প্রতি বছরই নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিনাজপুর দশমাইলের সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে ইয়াসমিন স্মৃতি পরিষদ। এ ছাড়া ইয়াসমিনের কবর জিয়ারত ও দোয়া মাহফিল হবে।
ইয়াসমিনের মা শরীফা বেগম দোয়া অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নিজবাড়িতে দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করবেন খাবার।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: