কারখানায় অগ্নিকাণ্ড: ১০ দিন পর মিলছে পোড়া হাড়

সময় ট্রিবিউন | ১৮ জুলাই ২০২১, ০৫:১৪

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনায় গঠিত সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে ১৯ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিনিধি দল শনিবার কারখানাটি পরিদর্শন করে। ছবি: সংগৃহীত

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের দশম দিনে চতুর্থ তলায় মিলল মানুষের পোড়া হাড়। কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনায় গঠিত সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে ১৯ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিনিধি দল তদন্তে শনিবার দুপুরে এসে এসব হাড় দেখতে পায়।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কমিটির প্রতিনিধি দলের সদস্য ও গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার লিমা।

তাসলিমা আখতার লিমা বলেন, কারখানার ৪ তলায় দক্ষিণ পূর্বকোণের একটি পোড়া স্তুপের পাশে দুর্গন্ধ পাই। সেই দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাই মানুষের হাড় পড়ে আছে। যার উপর মাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে এটি কোনো নারীর শরীরের অংশ। কারণ এ হাড়ের সঙ্গে নারীর পায়জামা দিয়ে মোড়ানো আছে।’

তিনি বলেন, এর থেকে ধারণা করা যাচ্ছে, যেহেতু এখানে এখনও হাড় পড়ে আছে। সেহেতু চার তলার পোড়া স্তুপের নিচে আরও মরদেহ কিংবা মানুষের পোড়া হাড়ের অংশবিশেষ থাকতে পারে। এ বিষয়গুলো আরো তদন্ত করলে মুত্যুর সংখ্যা বের হয়ে আসবে।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক তানহারুল ইসলাম জানিয়েছে দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তবে হাড় আছে কিনা সেটা তল্লাশি করে দেখা হচ্ছে।

কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আশা করি ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে এ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমরা প্রকাশ করবো। এ রিপোর্টে যেমন আমাদের কারণ অনুসন্ধান থাকবে, দায়িত্ব নির্ধারণ করবো (কার কার কী দায়িত্ব ছিল)। সমস্ত কিছুর পর আমাদের নির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ থাকবে। এ সুপারিশ শুধু মাত্র এ কারখানার জন্য না। সামগ্রিকভাবে আমাদের যে শিল্পখাত, সেই শিল্পখাতকে আরও নিরাপদ এবং শিল্পখাতে যারা কাজ করে তাদের জীবনকে আরও নিরাপদ করার জন্য এবং শিল্পখাত যেন আরও টেকসই হয় সেটি বিবেচনায় রেখে আমরা সুপারিশ দেবো। আশা করি এবং দাবি করবো সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসহ মালিকপক্ষ সেইসমস্ত সুপারিশমালার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানায় বা কর্মস্থলে অগ্নিকাণ্ড, অগ্নিকাণ্ডে অকাল মৃত্যু এবং বিভিন্ন হতাহতের ঘটনায় আমাদের এটিই প্রথম তদন্ত। আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে, বাংলাদেশে যেসব কারণে শিশু কিশোর থেকে শুরু করে নারী পুরুষ অকালে মারা যাচ্ছে, সেসব কারণ দূর করা খুবই সম্ভব। কিন্তু আমরা দেখছি কারখানায় আগুন লাগছে কিংবা রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগছে, গ্যাস থেকে যে কারণে আগুন লাগছে, লঞ্চে ধাক্কা মেরে লঞ্চে মানুষ মারা যাচ্ছে, বিভিন্ন অকাল মৃত্যু। এ অকাল মৃত্যুর পর সরকার থেকে তদন্ত কমিটি হয়, সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্টও প্রকাশিত হয় না, দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয় না এবং যে প্রতিকার করা দরকার সেটাও হয় না। তার ফলে এ ঘটনা বার বার ঘটতে থাকে।

তিনি বলেন, রানা প্লাজা বা তাজরিনের ঘটনায় এতো বছর পরও এর বিচার এখনও পর্যন্ত সমাপ্ত হয়নি। দায়ী ব্যক্তিদেরও বিচার হয়নি। ফলে যে সমস্ত কারখানায়, যে সমস্ত বিধিমালা অনুসরণ করা দরকার, নিয়মাবলী থাকা দরকার সেগুলো থাকে না। সেই কারণে আমরা দায়িত্ববোধ করেছি। সরকার থেকে কয়েকটি কমিটি করা হয়েছে। আমাদের নাগরিকদের একটা দায়িত্ব আছে এটা সাংবিধানিকভাবে আমাদের দায়িত্ব ও অধিকার যে, এটার আসল কারণ বের করা। এটা শুধু মাত্র হাসেম ফুডসের অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানের জন্যই নয়, পুরো বাংলাদেশে কারখানাগুলো যেভাবে চলে, শ্রমিকদের যে কর্মপরিবেশে কাজ করতে হয়, সরকারি যেসমস্ত প্রতিষ্ঠান যে ধরনের দায়িত্ব পালন করে কিংবা করে না সেগুলো যদি প্রতিকার না হয় তাহলে এ ধরনের অকাল মৃত্যু বার বার ঘটতে থাকবে। সেজন্য আমরা এ বিষয়টাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে এ কমিটি করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আজকে আমরা সরেজমিন আনুসন্ধান করতে এসেছি। যেভাবে আগুন লেগেছিল, আমাদের দেখার বিষয় আগুন লাগার কারণ কী এবং কেন আগুন লাগে? আগুন দুর্ঘটনাবসত লাগতে পারে। সেই আগুন লাগার জন্য কোন কোন পরিস্থিতি তৈরি হলো কীভাবে, সেটা কি কারখানার কোনো ধরনের অনিয়ম ছিল কিংবা কী ধরনের ব্যবস্থা ছিল, বের হওয়ার সিঁড়ি আমরা এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। বের হওয়ার সিঁড়ি কেন থাকলো না। অগ্নিনির্বাপনে যেসমস্ত প্রশিক্ষণ দরকার শ্রমিকদের বা ব্যবস্থাপকের, সেইসমস্ত প্রশিক্ষণ ছিল কিনা। আমরা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। আমরা এরপর সরকারি যেসমস্ত প্রতিষ্ঠান আছে মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলবো।

৮ জুলাই রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকার হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৪৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তিন জন লাফিয়ে পড়ে মারা যান। এ ঘটনায় পুলিশ বাদি মামলা করেন। মামলায় কারখানার মালিক মো. আবুল হাসেমসহ তার চার ছেলে ও ডিজিএম, এজিএম ও ইঞ্জিনিয়ারসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে ২ জন জামিনে মুক্ত হলেও কারখানার মালিক আবুল হাসেমসহ ৬ জন কারাগারে আছেন।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: