বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সরকার যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, সেটি মাত্র দুদিন পরই ভেঙে পড়েছে। সরকারি প্রজ্ঞাপনে ‘লকডাউন’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘সার্বিক কার্যাবলি’ বা চলাচলে ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ আরোপ করার কথা বলা হলেও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ওই বিধিনিষেধকে ‘লকডাউন’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
কিন্তু দৃশ্যত প্রথম দিন থেকেই কোথাও ‘বিধিনিষেধ’ বা লকডাউনের লেশমাত্র ছিল না। মার্কেট ও দোকানপাট খোলা রাখার দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়েছে। কোথাও কোথাও এই বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। এমন অবস্থায় যেসব ‘বিধিনিষেধ’ সরকার আরোপ করেছিল তার কোনো কোনোটি থেকে তারা নিজেরাই পিছু হটেছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক অবশ্য সাংবাদিকদের বলেছেন, লকডাউন কার্যকর করার জন্য সরকার আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কঠোর হতে চায়নি। জনগণ যাতে সচেতন হয় সে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিধিনিষেধ কার্যকর করতে না পারার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
কারণগুলোর মধ্যে আছে ১. বাস বন্ধ করে প্রাইভেট কার চালু রাখা; ২. কারখানা খোলা রেখে মার্কেট বন্ধ রাখা; ৩. অফিস খোলা রেখে গণপরিবহন বন্ধ রাখা; ৪. বইমেলা খোলা রেখে ক্ষুদ্র ব্যবসা বন্ধ করা এবং ৫. সরকারি অফিস সীমিত করে বেসরকারি অফিস পুরোদমে চালু রাখা।
বাস বন্ধ, প্রাইভেট কার চালু : সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ অনুযায়ী বিধিনিষেধ কার্যকর করার প্রথম দিন থেকে গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা গেছে শহরজুড়ে প্রাইভেট কার চলছে। এ ব্যবস্থাকে একটি বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন পরিবহন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ ছাড়া পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে ‘লকডাউন’ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে যে ‘লকডাউন’ দেওয়া হয়েছিল সেটি প্রায় দুই মাস চলেছে নানা বিধিনিষেধের আওতায়। এজন্য এবার সে ধরনের পরিস্থিতি মেনে নিতে একবারেই রাজি ছিলেন না পরিবহন শ্রমিকরা। ফলে দুদিনের মাথায় সরকারও বাধ্য হয়েছে শর্তসাপেক্ষে বাস চলাচলের অনুমতি দিতে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন যে মানুষের যাতে অফিসে যেতে সুবিধা হয় সেজন্য শর্তসাপেক্ষে বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
কারখানা খোলা, মার্কেট বন্ধ : পোশাক কারখানাগুলো বরাবরই অন্যসব সরকারি বিধিনিষেধের আওতার বাইরে ছিল। ২০২০ সালের লকডাউনেও যখন সবকিছু বন্ধ ছিল, তখন পোশাক কারখানাগুলো খোলা রাখা হয়। এবারও শুরু থেকেই গার্মেন্টসহ শিল্প-কারখানাগুলো বিধিনিষেধের বাইরে ছিল।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভে অংশ নেওয়া দোকানের কর্মচারীদের অন্যতম যুক্তি যেখানে সব শিল্প-কারখানা খোলা আছে সেখানে শুধু মার্কেট-শপিং মল বন্ধ করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কীভাবে থামানো যাবে?
তা ছাড়া গত বছর লকডাউনের কারণে ঈদ এবং পহেলা বৈশাখের কেনাকাটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবারও সে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এজন্য দোকানিরা উদ্বিগ্ন হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আবদুল হামিদ বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, ‘কিছু খোলা রেখে কিছু বন্ধ রেখে তো হয় না। এটা তো পুরোপুরি বৈপরীত্য। সবকিছু বন্ধ থাকলে মানুষ তখন উদাহরণ দেখাত না, অজুহাত খুঁজত না।’
অফিস খোলা, পরিবহন বন্ধ : সরকারি বিধিনিষেধ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সব সরকারি-বেসরকারি অফিস শুধু জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় অফিসে আনা-নেওয়া করতে পারবে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে বেশির ভাগ অফিসের নিজস্ব কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই। একদিকে অফিস খোলা এবং অন্যদিকে রাস্তায় গণপরিবহন না থাকায় চরম বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করতে বহু টাকা খরচ হচ্ছে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভও তৈরি হয়।
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা শারমিন আহমেদ বলেন, ‘অফিস খোলা রাখল কেন? পরিবহন যখন বন্ধ করেছিল তখন তো অফিসও বন্ধ রাখা উচিত ছিল।’
বইমেলা খোলা, ক্ষুদ্র ব্যবসা বন্ধ : এবারের ‘লকডাউনে’ যে বিষয়টি অনেককে বিস্মিত করেছে, সেটি হচ্ছে ঢাকায় বইমেলা চালু রাখা। একদিকে বইমেলা চালু রাখা হয়েছে, অন্যদিকে বিভিন্ন দোকান বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও রয়েছেন যারা দৈনন্দিন রোজগারের ওপর নির্ভর করেন।
ব্যবসায়ীদের যুক্তি হচ্ছে বইমেলা চালু রাখলে যদি সংক্রমণ না বাড়ে তাহলে কি তাদের ব্যবসা চলমান থাকলে সংক্রমণ বাড়বে?
পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ড. শারমীন ইয়াসমিন বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত খুবই সাংঘর্ষিক হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই। এগুলো নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে।’
সরকারি অফিস সীমিত, বেসরকারি অফিস পুরোদমে : সরকারি প্রজ্ঞাপনে যদিও বলা হয়েছে যে সরকারি-বেসরকারি অফিস শুধু জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক লোকবল দিয়ে কাজ করাবে। প্রকৃতপক্ষে বেসরকারি অফিসগুলোর জন্য এই নির্দেশনা সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ফলে বেসরকারি চাকরিজীবীদের মনে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: