বিদিশার দুই ছেলের জন্ম একদিনেই, বাবা আলাদা!

সময় ট্রিবিউন | ৭ জুলাই ২০২১, ২১:০৯

বিদিশা সিদ্দিকের কোলে ছেলে শাহাতা জারাব এরশাদ এরিক-ফাইল ছবি

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকের দুই ছেলের সন্তানের জন্ম তারিখ ও বাবার পরিচয় নিয়ে বড় ধরনের ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। দুই ছেলের জন্মনিবন্ধন সনদে দেখা গেছে, শাহাতা জারাব এরশাদ (এরিক) এবং এরিক ওয়েন হুইসনের জন্ম ২০০১ সালের ১১ মার্চ। জন্মস্থান ঢাকা। অর্থাৎ দুই সন্তানের জন্ম হয়েছে একইদিনে। কিন্তু শাহাতা জারাব এরশাদের (এরিক) বাবার নাম লেখা হয়েছে এইচএম এরশাদ এবং এরিক ওয়েন হুইসনের পিতার নামের ঘরে লেখা আছে পিটার স্টুয়ার্ট হুইসন। দুই ছেলে সন্তানের জন্মতারিখ একই দিন লেখা থাকায় ধরে নিতে হবে তারা যমজ ভাই। বিদিশা যমজ পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু তাদের পিতা দুজন হওয়ায় বড় ধরনের প্রশ্ন সামনে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, জন্ম নিবন্ধনে দুই ছেলের জন্ম ঢাকায় বলা হলেও বিদিশার পাসপোর্টের বিদেশ সফরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তিনি ওইদিন ছিলেন সিঙ্গাপুর। এছাড়া শুধু সন্তান নয়, বিদিশা তার নিজের জন্ম তারিখ নিয়েও দুরকম তথ্য দিয়েছেন।

বুধবার জাতীয় দৈনিক যুগান্তর এসংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যুগান্তরের মাসব্যাপী অনুসন্ধানে বিদিশার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এ রকম রহস্যময় ও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এদিকে শাহাতা জারাব এরিকের বাবার পরিচয় নিয়ে এরকম চাঞ্চল্যকর তথ্য অমীমাংসিত থাকা অবস্থায় বর্তমানে বিদিশা সিদ্দিক অনেকটা নির্বিঘ্নে সময় পার করছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায়। আছেন ছেলের সঙ্গে। এইচএম এরশাদ ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মারা যাওয়ার ৪ মাসের মাথায় নভেম্বরে বিদিশা এ বাসায় ওঠেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এরশাদ পরিবারের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত সাতক্ষীরা-৪ আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ও হুইপ এইচএম গোলাম রেজা ওই প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘চরম সত্য হলো- শাহাতা জারাব এরিক এরশাদ স্যারের সন্তান নন। বিদিশা প্রতারণা করে জন্মনিবন্ধনে পিতা হিসাবে এরশাদের নাম যুক্ত করেছেন। পারিবারিক আদালতে এ সংক্রান্ত মামলায় বিদিশা হেরে গেছেন। এরশাদের আইনজীবীর জেরার মুখে বিদিশা সব সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হন।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘নিম্ন আদালতে এ মামলায় হেরে যাওয়ার পর বিদিশা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আদালত বিদিশার আপিলও খারিজ করে দেন। আপিল নম্বর ৬১/২০১১। অথচ এখন আবার ওই ভুয়া পরিচয়কে সামনে এনে ছেলের মায়ের দাবি নিয়ে বিদিশা বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে উঠেছেন। বিষয়টি খুবই অপ্রত্যাশিত ও বেআইনি।’ তিনি মনে করেন, ‘যেহেতু বিষয়টি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর বিষয়। তাই সরকারের উচিত হবে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে বিষটির একটি সুরহা করা।’

যুগান্তর তথ্য অনুসন্ধান করে দেখিয়েছেন, ২০০৫ সালের ৩ জুন বিদিশাকে তালাক নোটিশ পাঠান এরশাদ। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের তালাকসংক্রান্ত সালিশি কেস নম্বর ১৬৬৫/২০০৫। এ সালিশের মাধ্যমেই তালাক কার্যকর হয় ওই একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর। সে সময় এরশাদ-বিদিশার ছাড়াছাড়ি হলেও শিশুসন্তান শাহাতা জারাব এরিককে নিজের জিম্মায় রাখেন এরশাদ। কিন্তু এটা মেনে নিতে পারেননি বিদিশা। তালাকের ৫ বছর পর অর্থাৎ ২০০৯ সালে শাহাতা জারাব এরিককে নিজ জিম্মায় নিতে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন বিদিশা। মামলা নম্বর ৮৮৮/২০০৯। এ মামলায় এরশাদের আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলামের দীর্ঘ জেরার মুখে বিদিশা তার জীবনের নানা কাহিনী প্রকাশ করেন।

বিদিশার জেরাসংক্রান্ত নথির এক জায়গায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন বিদিশা। তার প্রথম বিয়ে হয় ১৯৮৩ সালে। স্বামীর নাম পারভেজ আহমেদ। পাসপোর্ট নং এফ ২২১৩৫৫। বিদিশার জন্মস্থান ভারত হলেও পাসপোর্টে উল্লেখ করা হয় বাগেরহাট। তার জন্ম ১৯৬৭ সালের ১ জুলাই।

জেরার নথিতে দেখা যায়, বিদিশা নিজেই জানান, মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৮৪ সালে নাবালিকা অবস্থায় তার প্রথম বিয়ে হয় গ্রীন রোড কাজী অফিসে। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন বাবার বন্ধু সিঙ্গাপুরের নাগরিক পিটার স্টুয়ার্ট হুইসনকে। এ বিয়ের সুবাদেই সিঙ্গাপুরে গিয়ে বেশ কিছুদিন স্থায়ী বসবাস করেন তিনি। ওই ঘরে তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে হয়। ১৯৮৭ সালের ২৩ নভেম্বর তার প্রথম ছেলে উইলিয়াম জেমস হুইসনের জন্ম হয়। ১৯৯০ সালের ১৬ জুলাই জন্ম নেন তার মেয়ে ইসাবেল ইমা হুইসন। তখন তিনি সিঙ্গাপুরের ২৭ এ নানইয়াং, ডাক-ভিউ, পোস্ট কোড ২২৬৩ এলাকায় বসবাস করতেন।

প্রতারণা যেভাবে: ২০০০ সাল থেকেই এরশাদ-বিদিশার প্রেম কাহিনী টক অব দি কান্ট্রিতে পরিণত হয়। আলোচনা গড়ায় খোদ জাতীয় সংসদে। তখন আলোচিত এ জুটির সম্পর্ক নিয়ে চারদলীয় জোট সরকারের সময় জাতীয় সংসদে প্রশ্ন তোলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। যিনি এক সময় এরশাদ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বিষয়টি সংসদে উত্থাপন হওয়ায় লোকলজ্জার ভয়ে একটি এফিডেভিট নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে তাদের বিয়ের বিষয়টি প্রকাশ করা হয়। তবে বিয়ের সপক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ এফিডেভিটের বলে ২০০০ সালের ২৭ মার্চ থেকে বিদিশা এরশাদের স্ত্রী বলে দাবি করার সার্টিফিকেট পেয়ে যান।

২০০০ সালের ২৩ নভেম্বর রাজনৈতিক কারণে জাতীয় নির্বাচনের আগে জনতা টাওয়ার মামলায় কারাবন্দি হন এরশাদ। এ মামলায় উচ্চ আদালতের আদেশে এরশাদের ৬ মাসের জেল ও ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করা হয়। ওই সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন এরশাদ।

যে কারণে আদালত থেকেই তাকে ২০০০ সালের ২৩ ডিসেম্বর কারাগারে যেতে হয়। যদিও ৩ মাস পর ২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান জামিনে বেরিয়ে আসেন। ওই সময় এভাবে জেলে যাওয়ার কারণে তিনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যুক্ত থাকতে পারেননি।

এদিকে এরশাদ কারাগারে থাকাবস্থায় ২০০১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে চলে যান বিদিশা। তখন তার পাসপোর্টে স্বামীর নাম পিটার স্টুয়ার্ড হুইসন। পাসপোর্ট নম্বর পি ০১৮৭৯০৯। সিঙ্গাপুরের ভিসা নম্বর সিবি ৫৮২২৯১। পাসপোর্টের তথ্য বলছে, ১৩ দিনের মাথায় ১৩ মার্চ সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন বিদিশা।

তথ্যানুসন্ধানে বিদিশার পাসপোর্ট ও এ সংক্রান্ত নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০০১ সালের ১১ মার্চ এরিক ওয়েন হুইসন নামে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন বিদিশা। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে এরিক হুইসনের জন্মনিবন্ধন করা হয়েছে ২০০১ সালের ১০ এপ্রিল। সেখানে জন্মস্থান ঢাকা এবং পিতার নাম বলা আছে পিটার স্টুয়ার্ড হুইসন।

নিয়মানুযায়ী পিতা-মাতা জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক হলে সন্তান বিদেশে জন্মগ্রহণ করলেও দেশে তার জন্মনিবন্ধন করা যাবে। কিন্তু এখানে মা বাংলাদেশি হলেও পিতা সিঙ্গাপুরি নাগরিক। সেক্ষেত্রে সন্তানের জন্মনিবন্ধন বাংলাদেশে করোনা জটিল ও কঠিন। এটি হলো প্রথম প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, বিদিশা বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর যান ২০০১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি।

সেক্ষেত্রে সন্তান ১১ মার্চ ভূমিষ্ঠ হয়ে থাকলে সন্তান প্রসবের একেবারে শেষ মুহূর্তে তিনি কিভাবে বিমানে যেতে পারলেন? সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। এছাড়া তার পাসপোর্টের বহির্গমন তারিখ অনুযায়ী নিশ্চিত হওয়া গেছে যে- বিদিশা ১১ মার্চ সিঙ্গাপুর ছিলেন। তবে দুদিন পর ১৩ মার্চ তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন

যদিও দুদিন বয়সি সন্তান নিয়ে বিদিশার দেশে ফিরে আসার কথা নয় এবং একান্ত জরুরি না হলে কোনো মা এভাবে দেশে ফিরবেন না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, জন্ম দেওয়ার দুদিনের মাথায় বিদিশা দেশে ফিরে এসেছেন। কিন্তু তখন তার পাসপোর্টে নবজাতক সন্তানের কোনো তথ্য ইনডোর্স করা নেই। দেখা যাচ্ছে, তিনি একাই ফিরেছেন। তাহলে নবজাতক দুধের সন্তান এরিক হুইসনকে তিনি কার কাছে, কিভাবে রেখে আসলেন?

এদিকে ঢাকায় আসার ৪ মাস পর বিদিশা ২০০১ সালের ১৯ জুলাই তার পাসপোর্টে এক সন্তানের নাম ইনডোর্স করান। তাতে লেখা হয়েছে, ছেলের নাম এরিক ওয়েন হুইসন। পিতা পিটার স্টুয়ার্ট হুইসন। জন্ম নিবন্ধন নম্বর ২০০১২৩০০৯১৯০০২২৩১। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তানকে তিনি সিঙ্গাপুর রেখে এসেছেন তার নাম পাসপোর্টে ইনডোর্স করা হয়েছে।

এ নিবন্ধন দেখিয়ে বিদিশার পাসপোর্টে (পাসপোর্ট নম্বর পি ০১৮৭৯০৯) এরিক ওয়েন হুইসনকে ছেলে হিসাবে ঘোষণা করেন। যার সংযুক্তি নম্বর ২২০৫৪/২০০১। আগারপাঁও পাসপোর্ট অফিসের তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক মো. হযরত আলী ওই পাসপোর্টে স্বাক্ষর করেন। ওই সময় পাসপোর্টে সন্তানের ইনডোর্স করার নিয়ম ছিল।

এদিকে এ পাসপোর্ট নিয়ে ২০০১ সালের ৬ আগস্ট কলকাতা যান বিদিশা। ভিসা নম্বর ২৩৮২৯/২০০১। ১০ দিন পর ১৬ আগস্ট ফিরে আসেন। ওই সময় ছেলে হুইসনকে সঙ্গে নিয়ে যান। অর্থাৎ এতে প্রমাণিত হয় ২০০১ সালের ১১ মার্চ সিঙ্গাপুরে তিনি কোনো সন্তান জন্ম দেননি। এছাড়া তিনি পাসপোর্টে জন্ম নিবন্ধনের যে তথ্য দিয়েছেন সেখানে জন্মস্থান ঢাকা উল্লেখ করা আছে।

এর আগে ওই বছরের ২৯ এপ্রিল বিদিশা দুই বছর মেয়াদে লন্ডনের ভিসা নেন। এই ভিসায় ছেলে এরিক ওয়েন হুইসনকে লন্ডন নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পান একই বছরের ৫ অক্টোবর। ২০০২ সালের ১২ এপ্রিল ছেলেকে নিয়ে লন্ডন যান বিদিশা। ওই সময় তার পাসপোর্টে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও তিনি একই বছরের (২০০২) ২২ এপ্রিল লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে রহস্যজনক কারণে বিদিশা সিদ্দিক হুইসন নামে আরেকটি পাসপোর্ট (যার নম্বর কিউ ০৮৭৪৮৯১) করেন তিনি। সেখানেও এরিক ওয়েন হুইসনকে সংযুক্ত করা হয়। এরপর আর ওই ছেলের কোনো হদিস নেই।

এদিকে একই তারিখ দেখিয়ে (১১ মার্চ ২০০১) অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে শাহাতা জারাব এরশাদ এরিকের জন্ম নিবন্ধনও করা হয়েছে। নিবন্ধন নম্বর ২০০১১৩০০৯১৯০০২২৫১। সেখানে পিতা এইচএম এরশাদ। মাতা বিদিশা এরশাদ। পাসপোর্ট নম্বর আর ০৬৮৬৯১৭। একই দিনে জন্ম দেখানো হলেও দুই সন্তানের পিতা দেখানো হয়েছে দুজন।

এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। কিভাবে এক গর্ভে একই সময়ে দুই পিতার সন্তানের জন্ম হয়েছে তা নিয়ে এরশাদও তখন বিক্ষুব্ধ ছিলেন। যে কারণে প্রকৃত পিতার পরিচয় উদ্ঘাটনে খোদ এরশাদও বিদিশার বিরুদ্ধে আদালতে একটি ব্যাভিচারের মামলা করেন। মামলা নম্বর ১৬২/২০০৫। তবে জীবদ্দশায় লোকলজ্জার ভয়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের আশঙ্কায় এ মামলা আর চালাতে চাননি এরশাদ। যুগান্তরের কাছে এ সংক্রান্ত মামলার নথিপত্র সংরক্ষিত আছে।

এদিকে এরশাদের এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদিশার ইন্ধনে এইচএম এরশাদের সন্তানের পরিচয়েই বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন শাহাতা জারাব এরশাদ এরিক। এরশাদ ও বিদিশার সঙ্গে ২০০৩ সালের ১৮ জুন লন্ডনে যান এরিক। ভিসা নম্বর ইউকে ৮৩১০৪৬৬। ২০০৪ সালে ২৩ মে তিনি আমেরিকার ভিসাও পান। ভিসা নম্বর ২০৮৪১৪১৪৬১০০০২। এই ছেলেকেই এখন তুরুপের তাস বানাতে চাইছেন বিদিশা।

কে এ দুই সন্তান : প্রাপ্ত নথিপত্রের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শাহাতা জারাব এরিক এবং এরিক ওয়েন হুইসন- কেউই বিদিশার সন্তান নয়। তাহলে কার ঔরসজাত সন্তান তারা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ও হুইপ গোলাম রেজা ওই প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘জীবদ্দশায় এরশাদ নিজেই আমার হাতে কিছু ডকুমেন্ট তুলে দেন। তখন তিনি বলেন, বিদিশা কখনো এরিকের মায়ের দাবিতে প্রেসিডেন্ট পার্কে এলে তাকে উঠতে দেবে না। এরশাদের দেওয়া সেই নথিপত্রেই শাহাতা জারাব এরিক এবং এরিক ওয়েন হুইসনের মায়ের পরিচয় আছে বলে দাবি করেন গোলাম রেজা।

তিনি বলেছেন, ২০০০ সালের ২২ জুন গুলশান ২ নম্বরে অবস্থিত কামাল আতার্তুক এভিনিউয়ে গুলশান মা ও শিশু ক্লিনিকে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করান নাজনীন নামের জনৈক এক মহিলা। তার প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ আসে। এরপর ২০০১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাজারবাগের মোহাম্মদিয়া মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি ক্লিনিকে আলট্রাসনোগ্রাম করান নাজনীন। নাজনীনের নামে মেডিকেলের এ নথিপত্রে নিজ হাতে নিজের নাম লিখে ওভার রাইটিং করেন বিদিশা। বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় গোপনে সেই কাগজ রেখে দেন। অন্য কিছু খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ একদিন এইচএম এরশাদ নিজেই চাঞ্চল্যকর এ কাগজ পেয়ে যান। ওইদিনই এসব কাগজ আমার হাতে তুলে দেন এরশাদ।

এ বিষয়ে গোলাম রেজা যুগান্তরকে আরও বলেছেন, নাজনীনের কাগজপত্র চুরি করে নিজের নামে ডুপ্লিকেট কাগজ তৈরি করতে চেয়েছিলেন বিদিশা। সেই দুরভিসন্ধি থেকে কম্পিউটার টাইপ করা কাগজে নাজনীনের তথ্যের জায়গায় বিদিশার তথ্য হাতে লেখেন। ওই কাগজে বাংলাদেশের ডা. কানিজ খাতুন ই জান্নাতের নাম কেটে সিঙ্গাপুরের ডা. জেআই বন তানের নামে জাল ডকুমেন্ট তৈরি করতে চেয়েছিলেন বিদিশা। এরশাদের দেওয়া ডকুমেন্ট থেকে ধারণা করা যাচ্ছে, শাহাতা জারাব এরশাদ এরিক ও এরিক ওয়েন হুইসন অন্য কোনো মায়ের যমজ সন্তান। এ ব্যাপারে বিদিশাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই প্রকৃত রহস্য উন্মোচন হবে।

বিদিশার দুই জন্ম তারিখ: তথ্য অনুসন্ধানে বিদিশার দুটি জন্ম তারিখ পাওয়া যায়। এরশাদের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ানোর আগে তিনটি পাসপোর্টে তার জন্ম তারিখ ছিল ১৯৬৭ সালের ১ জুলাই। জন্মস্থান দেখানো আছে বাগেরহাট। ১৯৮৬ সালে তিনি প্রথম পাসপোর্ট গ্রহণ করেন (পাসপোর্ট নম্বর এফ ২২১৩৫৫)।

এই জন্ম তারিখের ধারাবাহিকতায় তিনি আরও দুটি পাসপোর্ট নেন (নম্বর এল ০৬০৩০৬৭, পি ০১৮৭৯০৯)। চার নম্বর পাসপোর্টে (নম্বর আর ০৬৮৭০৭২) তার জন্ম তারিখের সঙ্গে জন্মস্থানও পরিবর্তন করেন তিনি। জন্ম তারিখ উল্লেখ করা ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ। আর জন্মস্থান দেখানো হয় ঢাকা।

২০০৮ সালের ৬ জানুয়ারি এ পাসপোর্টের মেয়াদোর্ত্তীণের তারিখ থাকলেও ২০০৩ সালের ১৯ জুলাই লন্ডন দূতাবাস থেকে রহস্যজনক কারণে তিনি একটি ডুপ্লিকেট পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। যার নম্বর ডব্লিউ ০০৯৩৬০৩। লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা সৈয়দ নাজমুল হুদা পাসপোর্টে সই করেন। এরপর ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট করা জাতীয় পরিচয়পত্রে বিদিশার জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয় ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ। ঠিকানা উল্লেখ করা হয় তালাকপ্রাপ্ত স্বামী এইচএম এরশাদের বাসা ১০ দূতাবাস রোড বারিধারা। জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ১৯৭২৬৯২৬১৮৫০১৬১৫।

এরশাদ-বিদিশার বিয়ের ভিডিও: যুগান্তরের অনুসন্ধানে এরশাদ-বিদিশার বিয়ের একটি ভিডিও চিত্র পাওয়া যায়। ২০০২ সালে সিঙ্গাপুরে বিদিশার স্বামী পিটার স্টুয়ার্ট হুইসনের বাসায় এরশাদ-বিদিশার বিয়ের ভিডিওচিত্রটি ধারণ করেন তার ঘনিষ্ঠজনরা।

তাতে দেখা গেছে, সাদা রংয়ের বিয়ের গাউন পরা বিদিশার কোলে শিশু শাহাতা জারাব এরিককে। বিয়ের অনুষ্ঠানে এরশাদকেও দেখা যায় শিশু এরিককে নিয়ে খেলাধুলা করতে। অথচ ২০০১ সালের ১২ মার্চ সিটি করপোরেশন থেকে শাহাতা জারাব এরিখের নামে জন্মনিবন্ধন করা হয়। এ তথ্য বলছে, বিয়ের আগেই বিদিশার প্রতারণার ফাঁদে আটকে গিয়েছিলেন এরশাদ।

উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে বিদিশা সিদ্দিককে ফোন করেছিলেন প্রতিবেদক। তবে কোনো মন্তব্য না করে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবেদকের মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: