আজ ১৪ জুন, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ভূমিকা রাখছেন তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের উদ্দেশ্য। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘রক্ত দিন, পৃথিবীকে বাঁচান’।
১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’-এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে।
দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ রক্ত লাগে। এর কেবল ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে। বাকি ৭০ শতাংশ আসে রক্তগ্রহীতার স্বজন ও অপরিচিতদের কাছ থেকে। দেশে নারীদের মধ্যে রক্ত দেওয়ার সুযোগ ও প্রবণতা কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, রক্তদাতাদের মধ্যে কেবল ৬ শতাংশ হচ্ছেন নারী।
এদিকে গত বছর করোনাভাইরাসের প্রকোপের সময় বেড়েছিল রক্ত ও রক্তের উপাদানের চাহিদা। জরুরি প্রয়োজনের সময় রক্ত ও রক্তের উপাদানের সংকটের কথাও গণমাধ্যমে এসেছে। এর বিপরীতে করোনাভীতির কারণে মানুষ ঘর থেকে কম বেরিয়েছে। এ কারণে রক্তের সরবরাহও কম ছিল।
সরকারের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির হিসাবে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ৯ লাখ ৪২ হাজার ১৭২ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে গ্রহীতাদের দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে তা কমে আসে ২০২০ সালে। গত বছর সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৭ ব্যাগে। এই রক্তদাতাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই পুরুষ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জরুরি মুহূর্তে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন অনেক জীবন বাঁচায়। রক্তের চাহিদা চিরন্তন। কিন্তু যাদের প্রয়োজন, তাদের সবার জন্য রক্তের ব্যবস্থা করা সহজ কাজ নয়। প্রসূতির সিজারের সময়, দুর্ঘটনাকবলিতদের চিকিৎসায়, অস্ত্রোপচারের সময় এবং থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়মিত রক্তের দরকার হয়। রক্তদাতার হেপাটাইটিস-বি, সি, এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিস পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশুদ্ধ রক্তের সরবরাহ প্রকট।
রক্তদানে মানুষের মধ্যে দিন দিন সচেতনতা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে এখন খুব কম সময়েই রক্ত মিলে যায়। সারা পৃথিবীতেই রক্ত সংগ্রহ করা হয় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে। বাংলাদেশে অবশ্য চিত্রটা উল্টো। এখানে রক্তের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হয় স্বজন ও অপরিচিতদের মাধ্যমে।
রক্তরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীদের রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতনতা, উচ্চতা অনুযায়ী ওজন, রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক থাকা নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এসব কারণে নারীরা রক্তদানে কম উৎসাহ পান।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মেডিকেল অফিসার জাহিদুর রহমান বলেন, আজ থেকে ১০ বছর আগেও রক্ত দিতে নারীরা সংখ্যায় অনেক কম আসতেন। তবে এখন কিছুটা বেড়েছে। রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের আরও উৎসাহ দেওয়া উচিত।
রাজধানীর স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সারা সাজ্জাদ এ পর্যন্ত সাতবার রক্ত দিয়েছেন। রক্তগ্রহীতা সবাই ছিলেন তাঁর অপরিচিত। ফেসবুকের মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে তিনি রক্ত দিয়েছেন। তিনি সর্বশেষ এক থ্যালাসেমিয়া রোগীকে রক্ত দিয়েছেন এ বছরের মার্চে। সারা বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি রক্ত দেব। সবাই বলে মেয়েরা ভিতু। এই ভয় ভাঙতেই রক্ত দেওয়া শুরু করি। অন্যের উপকার হয়, তা দেখে খুব ভালো লাগে।
দেশে রক্তের সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের পরিচালক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, তবে করোনাকালে রক্তের একটা সংকট তৈরি হয়েছে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, স্বজন ও অপরিচিতদের মাধ্যমে দেশে রক্তের চাহিদা মেটে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে রক্ত নেওয়ায় নিরুৎসাহিত করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই পরিচালক বলেন, ভাই-বোন, স্বজনদের মাধ্যমে রক্ত পরিসঞ্চালন নিরাপদ নয়। কাছের আত্মীয়দের থেকে রক্ত নেওয়া হলে ‘গ্রাফট ভার্সেস হোস্ট ডিজিজ’–এর মতো দুরারোগ্য রোগের ঝুঁকি থাকে। এ কারণেই স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে রক্ত নেওয়াটা বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। তিনি জানান, স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে রক্তদানের চিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই তলানিতে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সারা দেশে ৩৪০টি রক্তদানকেন্দ্র আছে। এর মধ্যে সরকারি ২০৬টি এবং বেসরকারি কেন্দ্র আছে ১৩৪টি। এর বাইরে অনিবন্ধিত অনেক ব্লাড ব্যাংক ও প্লাজমা সেন্টার আছে। এসব জায়গা থেকে রক্ত নেওয়া নিরাপদ নয়।
নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির সাবেক পরিচালক ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মাজহারুল হক বলেন, দেশে রক্তের ঘাটতি না থাকলেও বিশুদ্ধ রক্তের অভাব আছে। বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকগুলো নিবন্ধন নেওয়ার সময় সব প্রক্রিয়া মেনে চলে। কিন্তু নিবন্ধন পেলেই রক্ত পরিসঞ্চালনে সব মান আর ধরে রাখতে পারে না। তিনি বলেন, ‘ব্যাঙের ছাতার মতো বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে ব্লাড ব্যাংকের নামে রক্তবাণিজ্য চলে। এসব রক্ত নিরাপদ কি না, তা দেখার কেউ নেই।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: