শুরু হলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি

সময় ট্রিবিউন | ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, ০৯:৩৯

শুরু হলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি

শুরু হলো বাংলা ও বাঙালির কালপঞ্জির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাস ফেব্রুয়ারি। আজ ১৮ মাঘ বৃহস্পতিবার ‘ভাষা আন্দোলনের মাস’ হিসেবে পরিচিত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সেটিকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে এই মাসেই রাজপথে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। সেই বীরদের অমলিন স্মৃতি স্মরণের মাস এই ফেব্রুয়ারি। আরও একটি কারণে ভাষা আন্দোলনের এই মাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো, ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই এই জনপদে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালিসহ অন্যান্য জাতিসত্তার জাতীয় চেতনার। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথ বেয়ে সংঘটিত হয় মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

বাঙালি ও বাংলাদেশের সঙ্গে ফেব্রুয়ারির চেতনস্রোত এত সুনিবিড়ভাবে মিশে আছে যে, এখনও ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’র কথা ও সুর বাজলে সেই ১৯৫২ সালের মতোই বেদনা ও প্রতিরোধের শপথ সিক্ত করে সবাইকে।

প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার, ভাষা আন্দোলনের শুরু মূলত ১৯৪৮ সালে- পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র মাস সাতেকের মধ্যেই এ আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। অবশ্য নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা নিয়ে ভারতবিভক্তির আগে থেকেই বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। এই বিতর্কের সূত্র ধরে ক্ষোভও সঞ্চারিত হয় বাঙালির মধ্যে। কেননা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বলতে গেলে একক সিদ্ধান্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চায় পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর ওপর। ওই সময়ের গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের লক্ষ্যে অধিবেশনে একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি এটি গণপরিষদে আলোচিত হয় এবং তমিজউদ্দিন খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের গণপরিষদ সদস্যরা এর তীব্র বিরোধিতা করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সেদিন বলেন, ‘পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষই চায় উর্দু হোক পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এভাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনীটি ভোটে বাতিল করে দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ঢাকার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জন কর্মসূচি পালিত হয়। পরে ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ সব জায়গায় প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। পুলিশ এদিন ছাত্রদের মিছিলে লাঠিচার্জ করে, অনেককে গ্রেপ্তারও করে। এমন প্রেক্ষাপটে ২ মার্চ গড়ে ওঠে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। একই বৈঠক থেকে ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। এই ধর্মঘট পালনের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৬৯ জন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে। ভাষা আন্দোলন পায় সুগভীর মাত্রা।

ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে গর্বের মাস। কারণ কি ১৯৪৮ সালে- কি ১৯৫২ সালে, এই ফেব্রুয়ারিতেই ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য এই মাসেই পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসেবে বাঙালি রক্ত দেয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাঙালির শহীদ দিবস পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি।

১৯৪৮ সালের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৫২ সাল। ইতোমধ্যে খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি পূর্ব বাংলার ২৭টি শিক্ষাকেন্দ্রে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রক্রিয়া শুরু করেন; পূর্ব বাংলার অধিবাসী হওয়ার পরও ওই বছর ২৭ জানুয়ারি এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, দুটি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে কোনো দেশ সমৃদ্ধির পথে এগোতে পারে না, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এ বক্তব্যের পর নতুন করে দানা বেঁধে ওঠে বিক্ষোভ ও ধর্মঘট। ৩১ জানুয়ারি (১৯৫২) ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় নতুন করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গড়ে ওঠে। যার আহ্বায়ক নিযুক্ত হন কাজী গোলাম মাহবুব। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। তাই ওই দিন সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। এই ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেই

১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় রাজপথে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চলে। শহীদ হন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, শফিউদ্দীন, সালামসহ আরও অনেকে। রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করে নেন বাঙালি তরুণরা। ভাষা আন্দোলনের ওই আত্মত্যাগই তৈরি করে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পথ।

১৯৫২ সালের দুই বছর পর ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তানের গণপরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৯৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের জন্য জাতিসংঘে আবেদন করেন কানাডাপ্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম। পরে ২০১০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের দিনটি তাই আজ বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন।

প্রথম দিনের কর্মসূচি : বাঙালি পাঠকের সবচেয়ে বড় উৎসব মাসব্যাপী ‘অমর একুশে বইমেলা’ শুরু হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার থেকে। জাতীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করছে জাতীয় কবিতা পরিষদ। আজ ও আগামীকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সংলগ্ন চত্বরে এই কবিতা উৎসব অনুষ্ঠানে হবে। জাতীয় কবিতা পরিষদের ৩৬তম এই আয়োজনের এবারের প্রতিপাদ্য : ‘যুদ্ধ গণহত্যা সহে না কবিতা’। কবিতা উৎসবে অংশ নেবেন ৮ দেশের কবি। এর মধ্যে ১০ জন সশরীরে উপস্থিত থাকবেন। কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা থেকে ৪টি দেশের ৮ জন কবি অনলাইনে এই উৎসবে যুক্ত হবেন। এ মাসে মাসব্যাপী জাতীয় পথনাট্যোৎসব আয়োজন করেছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুরু হয়ে ২০টি জেলায় চলবে এ উৎসব।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: