শুধু নামের একাংশ মিল থাকায় বিনা অপরাধ দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর কারা ভোগের পর অবশেষে আজ কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন হাছিনা বেগম। চট্টগ্রামে মাদক মামলায় ছয় বছর সাজাপ্রাপ্ত হাসিনা আক্তারের বদলে সাজা ভোগ করা হাছিনা বেগম ১ বছর ৪ মাস ২০ দিন পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আজ মঙ্গলবার (৪ মে) বিকাল পৌনে ৫টায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান।
আজ দুপুরে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ চতুর্থ আদালতের বিচারক শরীফুল আলম ভূঁঞার ভার্চুয়াল আদালত হাছিনা বেগমকে মুক্তির আদেশ দেন।
এর আগে সকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের বালাম বইয়ে সংরক্ষিত ছবি দেখে প্রকৃত আসামী হাসিনা আক্তার ও সাজা ভোগ করা হাছিনা বেগম এক নয় বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ।
হাছিনা বেগমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ জানান, আদালত হাছিনা বেগমকে কারাগার থেকে মুক্তির আদেশ দেওয়ার পর বিকেলে কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান।
এদিকে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর হাসিনা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, 'টেকনাফ থানায় যখন আমাকে নিয়ে আসা হয় তখনই আমি বারবার করে বলেছি আমি অপরাধী নই। কিন্তু উনারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। আমার কোনো কথায় উনারা বিশ্বাস করেননি।'
তিনি বলেন, 'বিনা অপরাধে প্রায় দেড় বছর জেল খেটেছি। আমার সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার ছোট ছোট বাচ্চারা পথে বসেছে। আমাকে জেল থেকে মুক্ত করতে আমার বাড়িটাও বিক্রি করতে হয়েছে।'
কারাগার সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার মইজ্যারটেক এলাকা থেকে ২ হাজার ইয়াবাসহ হাসিনা আক্তার ও হামিদ হোসেন নামের দুজনকে আটক করে পুলিশ। এ দম্পতি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে কর্ণফুলী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে। মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে হাসিনাকে ৪ বছর বয়সী ছেলে আনিস ও ২ বছরের মেয়ে নূর ফাতেমাসহ কারাগারে পাঠায় আদালত। এই মাদক মামলায় তাদের বিরুদ্ধে ৬ বছর সাজার আদেশ দেয় আদালত। পরে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর স্বামীসহ জামিনে মুক্তি পান আসামি হাসিনা আক্তার। মুক্তির পর আত্মগোপনে চলে যান তারা।
পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে আদালত ওয়ারেন্ট জারি করলে ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর মামলার আসামি হিসেবে নামের মিল থাকায় হাসিনা আক্তারের পরিবর্তে হাছিনা বেগম নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় আদালত। সে থেকে বিনা অপরাধে দীর্ঘ ১ বছর ৪ মাস ২০ ধরে সাজা ভোগ করছেন হাছিনা বেগম।
বিষয়টি চলতি বছরের ২২ মার্চ চট্টগ্রাম মহানগর অতিরিক্ত পঞ্চম আদালতের নজরে আনেন অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ। আদালত পুলিশকে বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয় এবং ৮ এপ্রিলের মধ্যে পুলিশকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেন আদালত। সর্বশেষ ৪ মের মধ্যে কারা রেজিস্টারে থাকা দুজনের গ্রেপ্তারকালীন ছবিসহ রেজিস্টার বই আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন। তাতে দেখা যায় মূল আসামি হাছিনা আকতার আর হাছিনা বেগম এক নয়, বিধায় হাছিনা বেগমকে মুক্তির আদেশ দেন আদালত।
এ বিষয়টি টেকনাফ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমিসহ এই থানার অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা নতুন যোগ দিয়েছি। আগে যারা ছিলেন তারা হয়তো নাম আর স্বামীর নামের কিছু অংশ মিল থাকায় হাছিনা বেগমকে গ্রেপ্তার করেছিলেন।'
তিনি আরও বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে আমি বিষয়টি অনুসন্ধান করে জানতে পারি হাছিনা বেগম নিরপরাধ। মূল আসামি হাসিনা আক্তার। দুইজনের বয়সেরও ভিন্নতা রয়েছে। তা ছাড়া হাসিনা আক্তারের স্বামী হামিদ হোসেনের বাবার নাম আব্দুল জলিল। কিন্তু হাছিনা বেগমের স্বামী হামিদ হোছনের বাবা প্রয়াত কবির আহমেদ। বিষয়গুলো প্রতিবেদনে উল্লেখ করে আমি আদালতে পাঠিয়েছি। বাকিটা আদালতের সিদ্ধান্ত।'
এ ব্যাপারে হাছিনা বেগমর আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ বলেন, 'পুলিশের গাফিলতির কারণে হাছিনা বেগম দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর সাজা ভোগ করেছেন। আমরা তাদের সাথে কথা বলে দায়ীদের ব্যাপারে কোর্টকে জানাবো, যেন ভিকটিম মহিলা আইনী প্রতিকার পায়। এবং যারা এটার জন্য দায়ী তাদের ব্যাপারে কোর্ট আইনী এ্যাকশন নেয়।'
তিনি আরও বলেন, 'পাশাপাশি আরেকটি বিষয়, ভিকটিম মহিলা দীর্ঘদিন জেলে ছিল তার যে ক্ষতি হয়েছে। সে একটা ক্ষতিপূরণ আমরা দাবী করবো। যাতে এ ধরণের অসহায় নিরাপদ মহিলারা যেন ভবিষ্যতে কারাগারে বিনা অপরাধে আটকে থাকতে না হয়। সে বিষয়টা আমরা আদালতের নজরে আনবো।'
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: