উত্তর কোরিয়ায় চলছে তীব্র খাদ্য সংকট

সময় ট্রিবিউন | ২৩ জুন ২০২১, ২২:৫৯

ছবি: ইন্টারনেট

উত্তর কোরিয়া অতীতে অনেক মারাত্মক দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এখন দেশটিতে তীব্র খাদ্যের সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম বেড়ে যাচ্ছে। এক কিলোগ্রাম ভুট্টার দাম হঠাৎ বেড়ে দাঁড়ায় দুই মার্কিন ডলারে। এই তথ্য ডেইলি এনকে ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি বাংলা।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার প্রায় দুই হতে তিন মাসের সরবরাহের পরিমাণ খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়, ‘যদি বাণিজ্যিকভাবে আমদানি এবং খাদ্য ত্রাণের মাধ্যমে এই ঘাটতি মেটানো না হয়, তাহলে ২০২১ সালের আগস্ট হতে অক্টোবর পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার পরিবারগুলোকে খুবই কঠিন এক মঙ্গার মুখোমুখি হতে হবে।’

এশিয়া প্রেস ওয়েবসাইটের খবর, উত্তর কোরিয়ায় প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম দ্রুত বাড়তে থাকে জুনের মাঝামাঝি। এই ওয়েবসাইটটি উত্তর কোরিয়ার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে পাচার করা কিছু ফোনের মাধ্যমে।

উত্তর কোরিয়ার মানুষ ভুট্টার চেয়ে ভাত বেশি পছন্দ করে, কিন্তু তারপরও তারা ভুট্টা বেশি খায়। কারণ এটি দামে সস্তা। এদিকে চালের দামও বেড়ে গেছে। দেশটিতে চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে চালের দাম বেশ উঠানামা করছে।

উত্তর কোরিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বেনজামিন সিলবারস্টাইন বলেন, উত্তর কোরিয়ার বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমেই দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো তথ্য পাওয়া যায়। কারণ উত্তর কোরিয়ার মানুষ বাজারে গিয়ে লেন-দেনের মাধ্যমেই তাদের খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে থাকে।

‘সরকারি কর্মচারীদের একেবারে ক্ষুদ্র একটি অংশই কেবল রাষ্ট্রের কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পেয়ে থাকে’ বলছেন তিনি।

সরকার যে রেশন দেয়, তা আসলে বেশিরভাগ পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আর বড় বড় নগরী থেকে যারা দূরে, তাদের জন্য তো এই রেশন মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। এর মানে হচ্ছে, বহু মানুষই তাদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে রাস্তার ধারে বসা অবৈধ বাজারের ওপর নির্ভরশীল।

প্যারিস-ভিত্তিক কৃষি পর্যবেক্ষণ সংস্থা জিওগ্লামের হিসেবে, ১৯৮১ সালের পর গত বছরের এপ্রিল হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে উত্তর কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। একের পর এক টাইফুন, আঘাত হেনেছে কোরিয়ান উপদ্বীপে। এরমধ্যে তিনটি টাইফুন উপকূলে আঘাত হেনেছিল গত আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে। উত্তর কোরিয়ায় এই সময়টি ছিল ধান এবং ভুট্টার ফসল তোলার মৌসুম।

দেশটিতে জুন মাস নাগাদ খাদ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠতে পারে। কারণ আগের বছরের শরৎকালের ফসল থেকে সরকার যে খাদ্য মওজুদ গড়ে তোলে, সেটা ততদিনে প্রায় ফুরিয়ে যায়। বিশেষ করে কোন বছর যদি ফসল মার খায়।

গত বছরের আগস্টের শুরুতে টাইফুন ‘হাগুপিট’ আঘাত হেনেছিল এবং এটি ছিল এমন একটি দুর্যোগ যেটির ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, বন্যায় ৪০ হাজার হেক্টর (এক লাখ একর) ক্ষেতের ফসল বন্যায় নষ্ট হয়েছে এবং ১৬ হাজার ৬৮০টি ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে।

এরপর আরও যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে, সেগুলোর ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে এড়িয়ে হয়।

উত্তর কোরিয়ায় কয়েক দশক ধরে যেভাবে বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছে, তার ফলে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি হচ্ছে। ১৯৯০ এর দশকে দেশটিতে যখন তীব্র অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, তখন জ্বালানির জন্য ব্যাপক হারে বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। এরপর নিয়মিত বৃক্ষ রোপণ অভিযান চালানো হলেও, বনাঞ্চল উজাড় অব্যাহত রয়েছে, যা বন্যার ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ গত মার্চে এক রিপোর্টে বলেছিল, ২০১৯ সালে উত্তর কোরিয়ায় ২৭ হাজার ৫শ’ হেক্টর বন উজাড় করা হয়েছে। ২০০১ সাল হতে এপর্যন্ত ধ্বংস করা হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমির গাছপালা।

এদিকে, উত্তর কোরিয়ার কৃষি খাতের বড় সমস্যাটি হলো সারের সংকট। সেখানে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট সার জোগাড় করা খুবই কঠিন। কিম জং আন এক চিঠিতে কৃষি খাতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বলেছিলেন যে, তারা যেন বিকল্প হিসেবে সহজে পাওয়া যায় এমন সারের উৎস খুঁজে বের করেন।

রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা কেসিএনএ’র প্রকাশ করা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘সব ধরনের গোবর ব্যবহার করুন, যেমন গৃহপালিত পশুর গোবর, মানুষের মল, গোবর সার এবং খাদের তলার মাটি।’

নিকেই এশিয়া গত ফেব্রুয়ারিতে জানিয়েছিল, উত্তর কোরিয়া সার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। দেশটির একটি প্রধান সার কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে।

অপরদিকে, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যেহেতু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি আছে, তাই অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য একেবারেই সীমিত আকারে।

এছাড়া সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ায় উত্তর কোরিয়ার খাদ্য ত্রাণ পেতেও সমস্যা হচ্ছে। যদিও দেশটিতে এই খাদ্য ত্রাণ নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে। উত্তর কোরিয়াকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য দেয় চীন। কিন্তু কোভিড প্যানডেমিক শুরু হওয়ার পর চীন হতে উত্তর কোরিয়ায় খাদ্য রফতানি ৮০ শতাংশ কমে গেছে।

জাতিসংঘ বলছে, গত দশকে দাতা দেশগুলো হতে উত্তর কোরিয়ায় যথেষ্ট ত্রাণ সাহায্য যায়নি। আর বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক খাদ্য ত্রাণ সংস্থা এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ায় কাজ করতে পারছে না। কারণ কোভিডের কারণে জারি করা বিধিনিষেধ মেনে সেখানে তাদের কাজ করা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) কুন লি বিবিসিকে জানিয়েছেন, মহামারির পর এ পর্যন্ত ডাব্লিউএফপি উত্তর কোরিয়ায় কোন গৃহস্থালি খাদ্য জরিপ চালাতে পারেনি। তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ২০২০ সালে ডাব্লিউএফপি সীমিত কিছু সরবরাহ সেখানে পাঠিয়েছিল এবং প্রায় ৭ লাখ ৩০ হাজার মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দিয়েছিল।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: