কাগজে কলমে সীমিত এলজিইডি'র কাজ, প্রকল্পে সুষ্ঠু তদারকির অভাবে চলছে শুভঙ্করের ফাঁকি

নাজমুস সাকিব মুন, পঞ্চগড় প্রতিনিধি | ২৫ জুলাই ২০২২, ০১:৩৮

সংগৃহীত

এলজিইডির দায়সারা মনোভাবে পুকুর চুরির অভিযোগ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে! পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদের পণ্য ও সেবা সহয়তা খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে এলজিইডি'র দায়িত্ব পালনে অনীহায় ঠিকাদারের সীমাহীন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তদারকি ছাড়াই ঠিকাদার শেষ করছেন কাজ। চলছে বিল উত্তোলনের পাঁয়তারা। নিয়ম অনুযায়ী কাজ তদারকি ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের।

সূত্র অনুযায়ী, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দেবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের "ইউনিয়ন পরিষদের পণ্য ও সেবা সহয়তা খাত'র" বরাদ্দ থেকে চেংঠী হাজরাডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন মেরামতের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাজটি পান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স তানিয়া কন্সট্রাকশন।

প্রাক্কলন অনুযায়ী, প্রত্যেকটি ঘরের ভেতরে প্লাষ্টিক পেইন্ট ও বাইরে ওয়েদার পেইন্ট এর পাশাপাশি ভবনের স্কার্টিং, দরজা, জানালা, গ্রিল, বারান্দার রেলিং রং করার জন্য ৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

ভবনের ক্ষতিগ্রস্ত প্লাস্টার তোলা, নতুনভাবে প্লাস্টার করা, সিসি ঢালাই, প্যাটেনস্টান ঢালাই সহ ভবন মেরামতে রাজমিস্ত্রীর কাজে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোনোরকম কাজ করা হয়নি। দরজা জানালা পরিবর্তনের জন্য ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও নামমাত্র মেরামত করা হয়েছে। ভবনে নতুন করে পিভিসি ও প্লেইন শিটের দরজা দেওয়ার জন্য প্রায় ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও সেটাও দেওয়া হয়নি। ছাদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত কাদামাটির টাইলস প্রতিস্থাপনের জন্য ১১ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও সেখানে পলেস্তরা দিয়ে কাজ করা হয়েছে।

মূল ভবনে দরজা-জানালার ফ্রেম পরিবর্তনের জন্য ৪৩ হাজার ও কপাট পরিবর্তনের জন্য ৭৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বর্ধিত ভবনে দরজা-জানালার ফ্রেম পরিবর্তনের জন্য ২৭ হাজার টাকা এবং কপাট পরিবর্তনের জন্য ৬৫ হাজার টাকা বরাদ্দ আছে। অথচ বর্ধিত ভবনে শুধু মাত্র দুইটি ফ্রেম পরিবর্তন করা হয়েছে। আর মূল ভবনে জানালার ২টি ও দরজার ৩টি ফ্রেম এবং দরজার ১টি ও জানালার ২টি কপাট পরিবর্তন করা হয়েছে।

ইলেকট্রিক কাজে ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড, এসডিবি বক্স, লাইন মেরামতের জন্য নতুন তার, ১০ টি নতুন পয়েন্ট, গ্যাং সুইচ, ফ্যান সহ ৮৬ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও মাত্র দুইটি গ্যাং সুইচ ও কয়েকটি এলইডি বাল্ব বসানো হয়েছে। ভবনের বেশ কয়েকটি স্থানে পুরনো ওয়ারিং সহ ঝুলে থাকা তার যে কারো চোখে পড়বে

স্যানিটারী কাজে উন্নতমানের পানির পাম্প, ফ্লাসিং ইউনিট সহ কোমড, বেসিন, আয়না, স্লাব সহ ইন্সপেকসন পিট, পিভিসি পাইপ ও ফিটিংস মালামাল বাবদ ৬৭ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও প্রাক্কলন অনুসরণ না করে পানির পাম্প সরবরাহ ছাড়া কোনো কাজ করা হয়নি। ভবনের সব ওয়াশরুমে এখনো পুরনো বেসিন ও কমোড রয়েছে।

টাইলস এর কাজের ক্ষেত্রে ঠিকাদার প্রয়োজনের চেয়ে বেশী করেছেন বলে দাবি করলেও সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় বরাদ্দ অনুযায়ী ৩৪ হাজার টাকার কাজটিও সঠিকভাবে করেনি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঠিকাদার নিজের মর্জি মতো কাজ শেষ করেছেন। ঠিকাদার নিজের ইচ্ছে মতো নামমাত্র চক পাউডার দিয়ে রং করেছেন ভবনের ভেতরে ও বাইরে। রং করার পূর্বে পুরনো রং ভাল ভাবে তুলে ফেলার কথা উল্লেখ থাকলেও তা করা হয়নি ঠিক ভাবে। ঘরের ভেতরে রং করার পূর্বে বাধ্যতামূলক সিলার ও পাট্টি ব্যবহারের নির্দেশনাও অনুসরণ করা হয়নি। ভবন রংয়ের কাজ এতটাই নিম্মমানের যে দেওয়ালে থাকা পুরনো পোস্টার ও লেখা পর্যন্ত এখনো দৃশ্যমান। ভবনের গ্রিল কিংবা রেলিংয়ে নেই রংয়ের লেশমাত্র।

এলজিইডি সূত্র বলছে, কাজটির তদারকির দায়িত্বে ছিলেন উপ সহকারী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দীক ও গৌতম রায় এবং কার্য সহকারী বৈদ্যনাথ কর্মকার। অজানা কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই উপ সহকারী প্রকৌশলী কাজটির তদারকিতে নিজেরা যেমন যান নি তেমনি কার্য সহকারীকে পাঠানোর প্রয়োজন মনে করেন নি।

ইউনিয়ন পরিষদে কর্মরত সচিব ও ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, কাজ চলাকালীন সময়ে মাত্র একদিন এলজিইডি'র প্রতিনিধিকে দেখেন তারা। অথচ ঠিকাদার কাজ করেছেন প্রায় ১৭-২০ দিন।

এলজিইডি'র নিয়ম অনুযায়ী কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি ধাপে অনুমতি ও কাজ সম্পাদনের তথ্য সংরক্ষণের জন্য 'সাইট অর্ডার' বই রাখা বাধ্যতামূলক হলেও সেটিও পালন করা হয়নি। সাইট অর্ডার বইয়ের বিষয়ে উপ সহকারী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক জানান, নিয়ম রয়েছে তবে ছোট কাজ হওয়ায় পালন করা হয়নি। ১০ লাখ টাকার কাজ কিভাবে ছোট কাজ হয় এমন প্রশ্ন করলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তিনি উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।

অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা বাড়তি সুবিধা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত প্রাক্কলন তৈরি করেছে। এতে কাজের মান দায়সারা হলেও বাড়তি সুবিধা পাবে ঠিকাদার ও দফতরের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা।

অজানা কারণে ছয়টি ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে চলমান মেরামত কাজে উপ সহকারী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিককে সাইট অফিসার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেখানে উপজেলা কার্যালয়ে তিনজন উপ সহকারী প্রকৌশলী কর্মরত আছেন। এরপরও চারটি প্রকল্পে শুধুমাত্র তিনি এবং বাকী দুইটিতে তিনি সহ অন্য দুইজন উপ সহকারী প্রকৌশলীকে নাম মাত্র সাইট অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

চেংঠী হাজরাডাঙ্গা ইউপি ভবনের সাইট অফিসারের দায়িত্বে থাকা অপর উপ সহকারী প্রকৌশলী গৌতম রায় বলেন, এর আগেও একবার অভিযোগ পেয়েছি নিম্ম মানের কাজের ব্যাপারে। বকর ভাই যেহেতু আমার সিনিয়র তাই উনিই সাইট তদারকি করেছেন। আমি কখনো সেখানে যাইনি। তাই এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। উপজেলা প্রকৌশলী নিজে সাইট ঘুরে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছেন।

এদিকে চেয়ারম্যানের কাছে কাজ সমাপ্তির প্রত্যয়ন পত্র নিয়েছেন বলে জানান মেসার্স তানিয়া কন্সট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী আবু তাহের চৌধুরী। তিনি জানান, কাজ শেষ করেছি তবে এখনো বুঝিয়ে দেই নি। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব পরিদর্শন করে কাজ বুঝিয়ে নিবেন। কক্ষগুলোর ভেতরে সিলার ও পাট্টি দিয়ে প্লাস্টিক পেইন্ট ও বাইরে ওয়েদার পেইন্ট করা হয়েছে বলে জানান ঠিকাদার। কাজে কোন অনিয়ম হয়নি বলেও জানান এই ঠিকাদার। বরং পুরো কাজে তিনি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন বলে দাবি করেন। বৈদ্যুতিক কাজে ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড, এসডিবি বক্স লাগানো হয়েছে দাবি করলেও বাস্তবে তা পাওয়া যায়নি।

চেংঠী হাজরাডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, কাজে অনিয়মের বিষয়টি আমি বেশ কয়েকবার উপজেলা প্রকৌশলীকে জানিয়েছি। তিনি দেখবেন বলে আর খোঁজ নেন নি।

উপজেলা প্রকৌশলী শাহরিয়ার ইসলাম শাকিল বলেন, আমরা কাজটি বুঝিয়ে নেই নি এখনো। কাজ বুঝিয়ে দিবে টাকা নিবে, সোজা কথা। চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান আর ঠিকাদার প্রত্যয়ন দিলে হবে, আমরা কি ঘোড়ার ঘাস কাটতে আছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম ফেরদৌস বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। প্রাক্কলন অনুযায়ী কাজ বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত কোন বিল দেওয়া হবে না। উপজেলা প্রকৌশলীকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: