ইসলাম শান্তির কথা বলে, মামুনুল সহিংসতার কথা বলেন

সময় ট্রিবিউন | ২১ এপ্রিল ২০২১, ২১:৩৬

সাংবাদিক ও কলাম লেখক প্রভাষ আমিন এবং হেফাজত নেতা মামুনুল হক

ইসলামের নামে মামুনুল হক যে ভাষায় উসকানি দিয়ে আসছিলেন, তার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক ছিল না। মামুনুল হক যে ভণ্ড, প্রতারক, মিথ্যুক সেটা আমি অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলাম। তবে সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে অভিসারের পর মামুনুল হকের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে।

রিসোর্টে মিথ্যা দিয়ে তার শুরু। তারপর একের পর এক মিথ্যার জালে জড়িয়ে পড়েছেন নিজে, সঙ্গে জড়িয়েছেন ইসলামকেও। এত দিন মামুনুল যা বলতেন তাই বিশ্বাস করতে হতো মানুষকে। কিন্তু এখন ধরা পড়ার পর তার বাকি আবরুটাও খসে গেছে। এখন সবাই বুঝে গেছে, মামুনুল একটা লম্পট ছাড়া আর কিছুই নয়। মামুনুলের মিথ্যার শুরু তার রিসোর্ট বুকিং থেকে। রিসোর্ট বুকিংয়ের সময় তার ওপর কোনো চাপ ছিল না।

সেখানে তিনি সঙ্গে থাকা নারীর নাম লেখেন আমেনা তৈয়েবা, এই নামটা তার প্রথম স্ত্রীর। অথচ তার সঙ্গে ছিল কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা। স্থানীয় লোকজন মামুনুলকে আটক করার পরও তিনি দাবি করেন, তার সঙ্গে থাকা নারীর নাম আমেনা তৈয়েবা। অথচ পরে তিনি নিজেই জানিয়েছেন, তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা।

প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপের সময়ও তিনি দাবি করেছেন, সঙ্গে থাকা নারী ‘আমগোর শহীদুল ভাইয়ের ওয়াইফ’। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য তিনি বলেছিলেন, তুমি আবার মাঝখান দিয়া কিছু মনে কইরো না। প্রথম স্ত্রী কিছুই মনে করেননি। টেলিফোনে কিছুই বলেননি। খালি বলেছেন, ‘বাসায় আসেন, কথা হবে’। প্রথম স্ত্রীর এই হুমকি মামুনুল হক নিতে পারেননি। রয়্যাল রিসোর্ট কেলেঙ্কারির পর মামুনুল আর বাসায় ফেরার সাহস পাননি। পুলিশের কাছে ধরা দেবেন, তবু প্রথম স্ত্রীর কাছে যাবেন না।

প্রথম স্ত্রী তেমন কিছুই করেননি, শুধু সন্তানদের নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। রয়্যাল রিসোর্টে ধরা খাওয়ার পর ফেসবুক লাইভে দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা স্বীকার করেছিলেন মামুনুল, সঙ্গে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ফাঁস হওয়া ফোনালাপ সবই সত্যি। তিনি বরং তার ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করে টেলিফোন কথোপকথন ফাঁস করার প্রতিবাদ করেছিলেন। বিভিন্ন পর্যায়ের ফাঁস হওয়া টেলিফোন সংলাপে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, মামুনুল আসলে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। করলেও সেটা তার প্রথম স্ত্রী এবং পরিবারের কেউ জানতেন না।

মামুনুল দাবি করেছিলেন, জান্নাত আরা ঝর্ণার সঙ্গে তার স্বামীর ছাড়াছাড়ির পর ‘মানবিক কারণে’ শরিয়তসম্মতভাবে তাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। এর মধ্যেই ফাঁস হয়ে যায় তার তৃতীয় বিয়ের খবর। যদিও সেটা স্বীকার করার মতো সময় তিনি পাননি।

মামুনুলের পিতা শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক একজন স্বঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধী। তবে তিনি ইসলাম বিষয়ে একজন আলেম ছিলেন। আর মামুনুল হক হলেন সেই আলেমের ঘরে জালেম। মুখে ইসলামের কথা বললেও তার চালচলন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, জীবনযাপন সব ইসলামবিরোধী। ইসলাম শান্তির কথা বলে। মামুনুল সহিংসতার কথা বলেন। ইসলাম নিয়মতান্ত্রিক জীবন বিধানের কথা বললেও, মামুনুলের পুরোটাই ছিল উচ্ছৃঙ্খল আর ইসলামবিরোধী।

ইসলামে চার বিয়ের অনুমোদন আছে বটে। তবে অবশ্যই দ্বিতীয় বিয়ের আগে প্রথম স্ত্রীর অনুমোদন নিতে হবে এবং সব স্ত্রীকে সমান মর্যাদা দিতে হবে। কিন্তু মামুনুল ধরা খেয়ে স্বীকার করা দ্বিতীয় স্ত্রীকে মর্যাদা তো দূরের কথা কোনো সামাজিক স্বীকৃতিই দেননি।

একটা মজার কথা বলে নিই। মামুনুল হকের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা। আর ফাঁস হওয়া তৃতীয় স্ত্রীর নাম জান্নাতুল ফেরদৌস লিপি। তার মানে জান্নাতের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। ইসলামে বলা আছে, পুণ্যবানরা মৃত্যুর পর জান্নাতে যাবেন এবং সেখানে তাদের জন্য ৭২ জন হুর অপেক্ষা করছে। কিন্তু মামুনুলের মনে হয় ধৈর্য একটু কম। মৃত্যুর পর জান্নাতে গিয়ে হুরের জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে দুনিয়াকেই জান্নাত বানিয়ে ফেলার প্রকল্প নিয়েছিলেন। তাই জান্নাত নামের নারীদেরই যেন তিনি টার্গেট করেছিলেন।

সাধারণ নৈতিকতায় দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার আছে। কেউ কারো ওপর জোর খাটালেই সেটা অন্যায়। কিন্তু ইসলামে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কোনো বৈধতা নেই। মামুনুল হক মুখে ইসলামের কথা বললেও যাপন করেছেন এক ইসলামবিরোধী জীবন। রিসোর্ট কেলেঙ্কারির পর থেকেই আমি মামুনুলের মিথ্যাচার নিয়ে বলে আসছি। তার ‘রুহানী পুত্র’রা সেটা বিশ্বাস করেনি। তারা বরং আমাকে মিথ্যাবাদী বলে আসছিলেন।

মামুনুল যখন নিজের সব মিথ্যার দায় স্বীকার করে নিলেন এবং ‘স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে সীমিত পরিসরে সত্য গোপন করার’ ফতোয়া জারি করলেন, তখন তাদের কারও কারও টনক নড়লেও সবার নয়। বাকি অন্ধরা বলতে চেষ্টা করল, ইসলামে চার বিয়ে করার অনুমোদন আছে। মামুনুলও হুঙ্কার দিলেন, আমি একাধিক বিয়ে করলে কার কী? মামুনুলের কথাবার্তার ধরন এবং কসম আর অভিশাপের বাহার দেখে আমি তখনই নিশ্চিত ছিলাম লম্পট মামুনুল আসলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো বিয়েই করেনি। কারণ, বারবার বলার পরও মামুনুল বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তখন তার রুহানী পুত্ররা দাবি করছিলেন, তিনি শরিয়তসম্মতভাবে বিয়ে করেছিলেন। অথচ এই মামুনুলই আগে বলেছিলেন, ইসলামে গোপন বিয়ের কোনো বৈধতা নেই। মামুনুলরা নিজেদের লাম্পট্য জায়েজ করার জন্য ইসলামকে নিজেদের মতো করে কাস্টমাইজ করে নেন।

পুলিশ রিমান্ডে যাওয়ার পর এখন মামুনুল স্বীকার করছেন, সকলি গরলে ভেল। তিনি বিয়ে শাদি কিচ্ছু করেননি। জান্নাত আরা ঝর্ণা এবং জান্নাতুল ফেরদৌস লিপির অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছিলেন তিনি। নামকাওয়াস্তে ভরণপোষণের বিনিময়ে তিনি তাদের দিনের পর দিন ভোগ করেছেন। মামুনুলের দাবি তিনি দুই জান্নাতের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। এখন বোঝা যাচ্ছে, জান্নাত আরা ঝর্ণার ডায়েরিই সত্য। ডায়েরিতে বিয়ের কোনো কথা নেই, আছে কন্টাক্টের কথা। এক লম্পট মামুনুল যে আমাদের কত কিছু শেখালেন। এখন তিনি দাবি করছেন, ‘কন্টাক্ট ম্যারেজ’। হে আল্লাহ, এই লম্পটদের কবল থেকে তুমি ইসলামকে হেফাজত কর।

মামুনুলের ভাগ্য ভালো, তারা যে বাংলাদেশ কায়েম করতে চান, সেটা এখনও হয়নি। হলে এত গ্রেপ্তার, রিমান্ডের সুযোগ তিনি পেতেন না। এত দিনে পাথর ছুড়ে এই জেনাকারীকে হত্যা করা হতো।

লেখক: প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও কলাম লেখক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: