আধুনিক সভ্যতার যুগে আমরা বসবাস করছি, ইন্টারনেট তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে মানুষ আরো বেশি আধুনিক হচ্ছে। নিজস্ব সংস্কৃতির কথা মানুষ ভুলে গিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখন গ্রামের প্রতিটি ছেলের কাছে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট। মুহূর্তের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত, ভিডিও ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে পারছে কিন্তু সার্বিকভাবে এটা তাদের মনে অপসংস্কৃতির বীজ বপন করছে।
আগে গ্রামে দেখতাম জেলেরা মাছ ধরার সময় বিভিন্ন রকম গান,গ্রামের উঠানে রাতে বিভিন্ন গানের আসর বসতো কিন্ত সেই স্মৃতিগুলো এখন কোথায় চলে গেল! আমরা দেখতাম গ্রামে সকালে প্রতিটি ছেলেমেয়ে মক্তবে যেতো, ধর্মীয় শিক্ষার জন্য। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে আমরা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি। মানুষের ভেতর নৈতিক অবক্ষয় এতটা তলানিতে চলে গেছে যা ভাবলে শরীরের লোম দাড়িয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আমার এক সহপাঠি সাথে আলাপচারিতা হলো অনেকদিন পর। উত্তরবঙ্গের কোন এক জেলায় বাড়ি আমার সহপাঠীর, কথার এক পর্যায়ে সে আমাকে বলল, বন্ধু দেশের অবস্থা এমন হচ্ছে এখন গ্রামের বাড়ি যেতে ভয় লাগে। আমি বললাম, কেন কি হয়েছে? তখন সে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ধর্ষণের কথা বলে শেষটুকু এই বলল যে, এখন বাড়ি থেকে বলে যদি সাথে কেউ আসে তাহলে বাড়ি আসবে না হলে আসার প্রয়োজন নেই। গত ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নরসিংদীর ঘোড়াশাল ফ্লাগ স্টেশন এলাকায় স্বামী-স্ত্রী ঘুরতে গেলে তিন বখাটে তাদের উত্ত্যক্ত করে, একপর্যায়ে বখাটেরা স্বামীকে মারধর করে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে।
অন্যদিকে গত ২ আগস্ট কুষ্টিয়া থেকে নারায়গঞ্জগামী যাত্রীবাহী বাস টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় ডাকাতির কবলে পরে। ঐসময় বাসে এক নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের স্বীকার হন। এই ঘটনার ঠিক চারদিন পর ৬ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুরে তাকওয়া পরিবহনের মিনিবাসে গণধর্ষণের স্বীকার হন এক গৃহবধূ। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে মাধ্যমে জানা যায়, কক্সবাজার সদর উপজেলার রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এক স্কুল শিক্ষিকাকে (২৫) দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। একইদিন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় সাতবছর বয়সী সন্তানের গলায় ছুরি ধরে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করে ইজিবাইক চালক ও চারযাত্রী (প্রথম আলো ২৪ আগস্ট ২০২২)।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি( এইচআরএসএস) এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে ১৮ বছরের কম বয়সী ৪২৪ জন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক ৩০৪ জন সহ মোট ৭২৮ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে (২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত)। এই ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে তাহলে সমাজের অবস্থা কোনদিকে ধাবিত হবে আমাদের একটু ভাবতে হবে। সমাজটা আমাদের, সমাজ, রাষ্ট নিয়ে শুধু সরকার ভাববে না কথাটি সঠিক না, ভাবতে হবে সচেতন জনসমাজকে।
আমাদের নিজেদের মনকে প্রশ্ন করতে হবে কেন আমারা সবার জন্য সহাবস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি না। আমাদের মনকে প্রশ্ন করতে হবে, নৈতিক মূল্যবোধ ও সুশাসন কেন আমাদেও মাঝে জাগ্রত হচ্ছেনা, যার ফলে আমাদেও সমাজের কোন স্থানে মেয়েরা নিরাপদ নয়। অফিস থেকে বাসা, বাজার থেকে রাস্তা, বিদ্যালয় থেকে বিশ^ বিশ্ববিদ্যালয় যদি সব জায়গায় মেয়েরা কটু দৃষ্টির শিকার হয় তাহলে একবার প্রশ্ন করেন নিজেকে কোথায় নিরাপত্তা পাবে আমাদের মা বোনেরা। তাই এখন উচিত হবে কঠিন আইনের পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অনুশাসনের। তা না হলে ধর্ষণের প্রবণতা ও ধর্ষণের সংখ্যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাবে। সমাজ হবে অন্যায়ের আতুরঘর।
লেখকঃ
প্রভাষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর-২০১২
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: