১৯৭৫ সালের ভয়াল ১৫ আগস্ট , বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে উপমহাদেশের বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক অন্নদাশংকর রায়ের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো,
‘‘ বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকে নাকো নীরব দর্শক,
ধিক্কারে মুখর হও। হাত ধুয়ে এড়াও নরক।’’
বাঙালির জাতীয় জীবনে আগস্ট মাস হলো এক নির্মম ইতিহাসের করুণ আর্তনাদ। আগস্ট মাস বাঙালি জাতির চির শোকের মাস। স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি শত্রুদের গৃহীত ষড়যন্ত্রমূলক নীলনকশা বাস্তবায়নের মাস হলো আগস্ট!
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকায় সংবাদ কভার করতে আসলে বিমানবন্দর থেকে জোর করে ফেরত পাঠানো হয় ব্রিটিশ সাংবাদিক ব্রায়ান মুনরো ব্যারনকে। তিনি লন্ডনে ফিরেই লিখেছিলেন,
‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক-চিহ্ন এবং তার কবরস্থান পুণ্য তীর্থে পরিণত হবে।’
দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় দলের নেতাকর্মীদের মাঝে কোন ধরণের আত্মতুষ্টিবোধ তৈরি হলে তা দল ও দেশের কল্যাণ বয়ে আনবেনা। কোনরূপ আত্মতুষ্টি কিংবা আত্মতৃপ্তি নয় বরং ১৯৮১ এর ১৭ মে তারিখে বঙ্গবন্ধুকন্যার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে স্বজনহারা সর্বহারা শেখ হাসিনার সেই অমর উচ্চারণ , ‘আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধি অর্জন করুন।’ নির্দেশনাকে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করতে হবে। আজকের বাস্তবতায় আওয়ামীলীগের আদর্শিক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে দলের দুর্দিনের পোড়খাওয়া কর্মীদেরকে প্রাপ্য সম্মান প্রদান ও মূল্যায়নের কোন বিকল্প নেই। অর্থ সম্পদ বা অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনেক জাতীয় পর্যায়ের নেতার আপোষ করার নজির থাকলেও আপামর কর্মীরা কোনদিন দলীয় আদর্শের প্রশ্নে আপোষ করেননি । পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর অমর উক্তির সাথে মিলিয়ে নিতে পারি , ‘এদেশের রাজনীতিবিদরা কথা বলেন পুরোহিতের মতো, কিন্তু; জীবন যাপন করেন রাজপুত্রের মতো।’ সাম্প্রতিককালে দেখা যায় অনেক ক্ষমতার উচ্ছিষ্টজীবী ভণ্ড ব্যক্তি মুজিবকোট গায়ে চাপিয়ে টিভির টকশো, মেঠো বক্তৃতায় মৌখিকভাবে মুজিব আদর্শের তুবড়ি ছোটালেও ব্যক্তিগতজীবনে তারা প্রতারণা দুর্নীতিসহ নানা কুকর্মে নিমজ্জিত। করোনাকালে রিজেন্ট হাসপাতাল ক্যালেঙ্কারির হোতা শাহেদ করিম, হেলেনা জাহাঙ্গীরদের মতো রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের সম্পর্কে জাতি ইতোমধ্যে জানলেও অনেক বড় মাপের দুর্নীতিবাজ অন্তরালেই রয়ে গেছেন !
কালোবাজারি , সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে পোড়খাওয়া দুর্দিনের নেতাকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন করে সক্রিয় করার বিকল্প নেই। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে উপলব্ধি ও ধারণ ব্যতিত দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী দিকনির্দেশনাকে পাথেয় করে জীবন যাপনে শুদ্ধাচার নিশ্চিত করতে হবে।
জাতির পিতার ভাষায়, ‘আমার আওয়ামী লীগ দলটির সাথে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক শব্দ দুটি জুড়ে দিয়ে প্রান্তজনের(কৃষক, শ্রমিক, ফসল উৎপাদনের সাথে সরাসরি জড়িত) সাথে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের উঠতি মধ্যবিত্ত, ধনিকশ্রেনির প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, চাকুরে, দুর্নীতিমুক্ত আমলাশ্রেনি প্রভৃতি শ্রেনিপেশার মানুষের সুসমন্বিত মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে একদিন সোনার বাংলা বিমির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘আপনারা ঐ গরীব কৃষককে সম্মান দিয়ে কথা বলুন ,তাঁর করের টাকায় আপনার আমার মাইনে হয়। ঐ গরীব কৃষক শ্রমিকরা-ই রাষ্ট্রের মালিক আপনি ওদের চাকর।’
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় নিয়োজিত জনগণের সেবকদেরকে দুর্নীতিমুক্ত থেকে দেশ ও জাতির কল্যাণে অঙ্গিকারবদ্ধ হতে হবে। মৃত্যুর পর অন্তিমযাত্রায় সাড়ে তিন গজ কাপড় কিংবা মুখাগ্নি ছাড়া কিছুই সঙ্গে যাবেনা। সে বেগমপাড়াই হোক আর লন্ডন হোক। কারোরই ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে , ‘মানুষ একটি মরণশীল জীব/প্রাণি!’
প্রসঙ্গত , ১৫ আগস্ট ভয়াল রাতে জাতির পিতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারীদের করুণ পরিণতি পূর্বেই দেখে ফেলেছেন প্রখ্যাত কবি ও দার্শনিক অন্নদাশংকর রায় তাঁর কবিতায়। কবির সেই অমর দার্শনিক বারতাবাহী কবিতাটি হলো ,
‘‘নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো
করে যদি যারা তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন
জাতির জনক যিনি অতর্কিত তাঁরেই নিধন।
নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর,
সারাদেশ ভাগী হয় পিতৃঘাতী সে ঘোর পাপের যদি দেয় সাধুবাদ,
যদি করে অপরাধ ক্ষমা।
কর্মফল দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে হয় এর জমা
একদা বর্ষণ বজ্ররূপে সে অভিশাপের।
রক্ত ডেকে আনে রক্ত, হানাহানি হয়ে যায় রীত।
পাশবিক শক্তি দিয়ে রোধ করা মিথ্যা মরীচিকা।
পাপ দিয়ে শুরু যার নিজেই সে নিত্য বিভীষিকা।
ছিন্নমস্তা দেবী যেন পান করে আপন শোণিত।
বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকে নাকো নীরব দর্শক,
ধিক্কারে মুখর হও। হাত ধুয়ে এড়াও নরক।’’
বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে অন্নদাশংকর রায়ের উক্ত দার্শনিক সত্যের অনবদ্য পঙক্তিমালা গভীরভাবে উপলব্ধি করা অত্যাবশ্যক। জাতির পিতার আজন্ম বিপ্লব , আত্মত্যাগ ও আন্দোলন- সংগ্রামের ইতিহাসকে উপলব্ধি করা আমাদের সবার কর্তব্য। শুধুমাত্র ৯ মাসের সসস্ত্র যুদ্ধেই কি বাঙালি জাতি পেয়েছে লাল-সবুজের এই মহান পতাকা? আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের সংগ্রামী ইতিহাসকে উপলব্ধি করতে হবে। পাকিস্তানি শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালি জাতির দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামকে যারা শুধুমাত্র ৯ মাসে সীমাবদ্ধ করতে চায় তাদের উদ্দেশ্য আর যা-ই হোক বাঙালি জাতির পক্ষেও নয়, প্রাসঙ্গিকও নয়। বাঙালি জাতিকে যিনি স্বতন্ত্র পরিচয়ে বিশ্বের বুকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছেন , এই পরাধীন বদ্বীপকে যিনি এনে দিলেন স্বাধীন সার্বভৌম মানচিত্র , লাল-সবুজের এই মহান পতাকা! সেই মহাকালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আজ স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়। পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুর প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী সংগ্রামী বাঙালি নারীর চিরন্তন অবয়ব বঙ্গমাতা শহীদ ফজিলাতুননেছা মুজিবকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা আধুনিক ক্রিড়াঙ্গনের স্বপ্নদ্রষ্টা শহীদ শেখ কামাল ও তাঁর স্ত্রী জাতীয় এথলেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সুলতানা কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ জামাল ও তাঁর নবপরিণীতা গর্ভবতী স্ত্রী রোজি জামালকে। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি এক দেবশিশুকে, কোমল অথচ দূরন্ত প্রাণপ্রাচুর্যের অমিত সম্ভাবনার আধার শহীদ শেখ রাসেল সহ ১৫ আগস্টে নিহত সকল মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ , বাংলা মায়ের বীর সন্তানগণকে।
এছাড়াও, ১৯৭৫ সালের ০৩ নভেম্বরে জেলখানায় জিয়াউর রহমান-মুশতাক আহমদ প্রশাসনের নির্দেশে জাতীয় চারনেতাকে জেলখানায় রাষ্ট্রের জিম্মায় রেখে হত্যা করা হয়েছিলো। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি জাতির পিতার ঘনিষ্ট সহচর মৃত্যুঞ্জয়ী বীর সন্তান জাতীয় চার নেতাকে । সালাম জানাই মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ ও জীবন-সম্ভ্রম হারানো লাখো বাঙালি মা বোনের স্মৃতির চরণে নিবেদন করি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
প্রসঙ্গক্রমে, যুগের পর যুগ ধরে বাকশাল শব্দটি দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শক্তি স্বাধীনতার মহান স্থপতি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারাজীবনের আন্দোলন সংগ্রাম কারাভোগ ও সকল মহৎকর্মকে অস্বীকার বা আড়াল করার নোংড়া প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাকশালের আদ্যোপান্ত সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর এক ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক আবীর আহাদ। নতুন প্রজন্মের জ্ঞাতার্থে ঐতিহাসিক সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:
আবীর আহাদ: বঙ্গবন্ধু, আপনার রাজনৈতিক চিন্তাধারার মূলনীতি বা লক্ষ্য কি?
বঙ্গবন্ধু: আমার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ধ্যান ও ধারণার উৎস বা মূলনীতিমালা হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার মূলনীতিমালার সমন্বিত কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শোষণহীন সমাজ তথা আমার দেশের দীনদুখী শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবি মেহনতী মানবগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের সমষ্ঠিগত প্রকৃত ‘গণতান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক’ শাসন প্রতিষ্ঠাকরণই আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারার একমাত্র লক্ষ্য।
আবীর আহাদ : বঙ্গবন্ধু, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কি একযোগে বা পাশাপাশি চলতে পারে?
বঙ্গবন্ধু : যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে তাকে সংখ্যালঘু ধনিক শোষকদের গণতন্ত্র বলাই শ্রেয়। এর সাথে সমাজতন্ত্রের বিরোধ দেখা দেয় বৈকি। তবে গণতন্ত্র চিনতে ও বুঝতে আমরা ভুল করি। কারণও অবশ্য আছে। আর তা হলো শোষক সমাজ গণতন্ত্র পূর্ণভাবে বিকাশলাভ করুক তা চায় না। এবং গণতন্ত্রকে কিভাবে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিণত করা যায়- এখানে চলে তারই উদ্যোগ আয়োজন। এভাবেই প্রকৃত গণতন্ত্রকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণ অজ্ঞ জনগণই শুধু নয়- তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন মানুষও প্রচলিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে বুঝতে অক্ষম। এরা ভাবে যে ভোটাভুটিই হলো গণতন্ত্র। একটু তলিয়ে দেখে না প্রাপ্তবয়স্ক মোট জনসংখ্যার কত পার্সেন্ট ভোট দিলো, কোন শ্রেনীর লোকেরা নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলো, কারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলো, ক্ষমতাসীনরা কোন পদ্ধতিতে তাদের শাসন করছে, সাধারণ জনগণ কতোটুকু কি পাচ্ছে। সুতরাং আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি- প্রচলিত গণতন্ত্রের বদৌলতে সমাজের মাত্র ৫% লোকের বা প্রভাবশালী ধনিকশ্রেনীর স্বৈরাচারী শাসন ও বল্গাহীন শোষণকার্য পরিচালনার পথই প্রশস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রচলিত গণতন্ত্রের মারপ্যাচে সমাজের নিম্নতম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শাসন ও প্রভাব প্রতিপত্তি, সর্বপ্রকার দূর্নীতি শোষন অবিচার অত্যাচার ও প্রতারণায় সমাজের সর্ববৃহত্তম অজ্ঞ দুর্বল মেহনতী কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানব গোষ্ঠীর (শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ) মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রকৃত গণতন্ত্র বলতে আমি এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝি, যে ব্যবস্থায় জনগনের বৃহ্ত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বৃহত্তর কল্যাণের নিমিত্তে তাদের জন্য, তাদের দ্বারা এবং তাদের স্বশ্রেণীভুক্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকার প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে তাদেরই প্রকৃত শাসন ও আর্থসামাজিক মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থা প্রচলিত গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্জিত হতে পারে না। কারণ প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ও আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে চলে অর্থ সম্পদের অবাধ ও মুক্ত প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে দরিদ্র জনসাধারণের পক্ষে এ জাতীয় আর্থ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া কোনো প্রকারেই সম্ভব না। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিই এদেরকে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের কার্যকরী নিশ্চয়তা দিতে পারে-তাদের আর্থ সামাজিক মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এজন্য আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্রের আরেক নাম সমাজতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যেই প্রকৃত গণতন্ত্র নিহিত। এজন্যেই আমি গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি। আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের ভেতর কোনো বিরোধ নেই।
আবীর আহাদ : অনেকে বলেন ‘বাকশাল’ হলো একদলীয় বা আপনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার একটি অপকৌশল- এ সম্পর্কে আপনি পরিষ্কার মতামত দিন?
বঙ্গবন্ধু : সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ পুঁজিবাদী সমাজসভ্যতা ও শোষক পরজীবিদের দৃষ্টিতে ‘বাকশাল’ তো একদলীয় শাসনব্যবস্থা হবেই। কারণ বাকশাল কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে আমি সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি বহুজাতিক পুঁজিবাদী শোষক, তাদের সংস্থা সমূহের লগ্নিকারবার এবং তাদের এদেশীয় সেবাদাস, এজেন্ট, উঠতি ধনিক গোষ্ঠীর একচেটিয়া শোষণ ও অবৈধ প্রভাবপ্রতিপত্তি-দুর্নীতি-প্রতারণার সকল বিষদাঁত ভেঙ্গে দেবার ব্যবস্থা করেছি। এজন্য তাদের আঁতে ঘাঁ লেগেছে, বাকশাল ও আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদীশক্তি শাসকরা এদেশে গোপনে অর্থ যোগান দিয়ে তাদের সেবাদাস ও এজেন্টদের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক কার্যক্রমকে বানচাল করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সভাসমিতি এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে আমার সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। কল-কারখানা, অফিস-আদালত, শিল্প-প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন থানায় তাদের ভাড়াটে চরদের দিয়ে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, গণহত্যা, অসামাজিক কার্যকলাপ ও সাম্প্রদায়িক তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিদিন তাদের ষড়যন্ত্রের খবরা-খবর আমার কানে আসছে।
প্রচলিত গনতান্ত্রিক বৈষম্য, শোষণ-দূর্নীতিভিত্তিক সমাজকে, দেউলিয়া আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, জরাজীর্ণ প্রশাসন ও অবিচারমূলক বিচার ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করে একটি শোষণহীন, দূর্নীতিহীন, বৈষম্যহীন ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজ বিপ্লবের পথ রচনা করেছি। এই সমাজ বিপ্লবে যারা বিশ্বাসী নন, তারাই বাকশাল ব্যবস্থাকে একদলীয় স্বৈরশাসন ব্যবস্থা বলে অপপ্রচার করছেন। কিন্তু আমি এ সকল বিরুদ্ধবাদীদের বলি, এতোকাল তোমরা মুষ্ঠিমেয় লোক, আমার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ দুখী মেহনতী মানুষকে শাসন ও শোষণ করে আসছো। তোমাদের বল্গাহীন স্বাধীনতা ও সীমাহীন দূর্নীতির মধ্য দিয়ে ব্যক্তিসম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অবাধ ও মুক্ত প্রতিযোগিতার হোলিখেলায় আমার দুখীমানুষের সব আশা-আকাংখা-স্বপ্ন-সাধ ধুলায় মিশে গেছে। দুখী মানুষের ক্ষুধার জ্বালা ব্যথা বেদনা, হতাশা-ক্রন্দন তোমাদের পাষাণ হৃদয়কে একটুও গলাতে পারেনি। বাংলার যে স্বাধীনতা তোমরা ভোগ করছো, এই স্বাধীনতা, এই দেশ, এই মাটি ঐ আমার দুখী মেহনতী মানুষের সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন সংগ্রাম এবং জীবন মৃত্যুর বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে তোমাদের অবদান কতটুকু আছে, নিজেদের বুকে একবার হাত দিয়ে চিন্তা করে দেখো। বরং অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছো। বিদেশী শাসক-শোষকদের সহায়তা করেছো। নিজের ঘরে থেকে ভাইয়ের ঘর পুড়িয়েছো, মানুষকে হত্যা করেছো। মা-বোনদের লাঞ্ছিত করেছো, আরো কি না করেছো! এসবই করেছো ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের ঘৃন্য লক্ষ্যে।
আমার দেশের মাত্র ৫ পার্সেন্ট লোক ৯৫ পার্সেন্ট লোককে দাবিয়ে রাখছে, শাসন-শোষণ করছে। বাকশাল করে আমি ওই ৯৫ ভাগ মানুষের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক শাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যবস্থা করেছি। এতকাল মাত্র ৫ ভাগ শাসন করেছে, এখন থেকে করবে ৯৫ ভাগ। ৯৫ ভাগ মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে ৫ ভাগকে মিশতে হবে। আমি মেশাবোই। এজন্য বাকশাল করেছি। এই ৯৫ ভাগ মানুষকে সংঘবদ্ধ করেছি তাদের পেশার নামে, তাদের বৃহত্তর কল্যাণে, তাদের একক দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশালে। মূলত বাকশাল হচ্ছে বাঙালীর সর্বশ্রেণী সর্বস্তরের গণমানুষের একক জাতীয় প্লাটফর্ম, রাজনৈতিক সংস্থা, একদল নয়। এখানে স্বৈরশাসনেরও কোনো সুযোগ নেই। কারণ বাঙালী জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত বা সমষ্ঠিগত শাসন ব্যবস্থায় কে কার উপর স্বৈরশাসন চালাবে? প্রত্যেক পেশার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে শাসন পরিষদ গঠন করা হবে। কোনো পেশা বা শ্রেণী অন্য পেশার লোকদের ওপর খবরদারী করতে পারবে না।
আবীর আহাদ : যে কেউ যিনি জনগনের সার্বিক কল্যাণের রাজনীতিতে তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তিনি এই জাতীয় দলে ভিড়তে পারবেন?
বঙ্গবন্ধু : যারা বাকশালকে একদলীয় ব্যবস্থা বলেন, তাদের স্মরণ করতে বলি, ইসলামে ক’টি দল ছিলো? ইসলামী ব্যবস্থায় একটি মাত্র দলের অস্তিত্ব ছিলো, আর তা হলো খেলাফত তথা খেলাফতে রাশেদীন। মার্কসবাদও একটি মাত্র দলের অনুমোদন দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম কিংবা অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রে কতটি করে দল আছে? এইসব ইসলামী রাষ্ট্রসমূহকে বাদ দাও, ওখানে মহানবীর(সা:) ইসলাম নেই। বস্তুত প্রকৃত গণতন্ত্র বা সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই একটি একক জাতীয় রাজনৈতিক সংস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। একটি জাতীয় কল্যাণের অভিন্ন আদর্শে, ব্যাপক মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে একটি মাত্র রাজনৈতিক সংস্থার পতাকাতলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বহুদলীয় তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় কোনোভাবেই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। সেখানে বহুদলে জনগণ বহুধা বিভক্ত হতে বাধ্য। আর বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত, পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্বসংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানির রাজনীতি দিয়ে জাতির বৃহত্তর কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কোনোভাবেই অর্জিত হতে পারে না। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় না। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও তাই বলে।
আবীর আহাদ : বঙ্গবন্ধু, বাকশালের মূল লক্ষ্য বা এর কর্মসূচী সম্পর্কে কিছু বলুন......
বঙ্গবন্ধু : বাকশালের মূল লক্ষ্য তো আগেই বিশ্লেষণ করেছি। তবে এক কথায় আমি যা বুঝি তা হলো একটি শোষণহীন, দূর্নীতিমুক্ত সমাজ ও শোষিতের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠাকরণ। বাকশাল কর্মসূচীকে আমি প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছি। এক. রাজনৈতিক, দুই. আর্থসামাজিক, তিন. প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা:-
এক) রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক পেশাভিত্তিক লোকদের জাতীয় দল বাকশালে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা রেখেছি। এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় দলের একাধিক প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। জনগণ তাদের মধ্যে থেকে একজনকে নির্বাচিত করবেন। প্রেসিডেন্ট জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। জাতীয় দলের সদস্য যে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট পদাধিকার বলে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান হবেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদের আস্থাভাজন একজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে মন্ত্রীদের নিয়োগ করবেন। সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের অনাস্থায় প্রেসিডেন্টকে অপসারিত করতে পারবেন। মন্ত্রীসভা প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী থাকবেন। স্থানীয় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সর্বস্তরের জনগণের প্রতিনিধিত্ব প্রত্যক্ষভাবে বজায় থাকবে।
দুই) আর্থসামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক বহুমূখী গ্রাম-সমবায় প্রকল্প। এর মাধ্যমে গ্রামীন আর্থব্যবস্থায় উন্নয়ন বা স্বনির্ভর-স্বাধীন গ্রামীন ব্যবস্থা, বিশেষ করে ভূমিসংস্কারের প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের পুনর্বাসন তথা কৃষকদের হাতে জমি হস্তান্তর, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সাম্যভিত্তিক বন্টন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। ভারী শিল্পকারখানা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, বৈদেশিক বানিজ্য, ব্যাংক, বীমা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি জাতীয়করণ করে জনগণের যৌথ শেয়ার মূলধনে নতুন নতুন কৃষিজাত শিল্প ও অন্যান্য শিল্প কলকারখানা ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা। সীমিত ব্যক্তিমালিকানাকে উৎসাহদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থাসমূহ যাতে জনসাধারণ ও তাদের শ্রমিকদের শোষণ করতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকবে।
তিন) প্রশাসনিক কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়, কর্পোরেশন ও বিভাগগুলোর পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন তথা মাথাভারী প্রশাসনের উচ্ছেদ সাধন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জেলা গভর্নর ও থানা প্রশাসনিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ, মহকুমা ও বিভাগীয় প্রশাসনকে তুলে দেয়া হচ্ছে। জেলা ও থানাগুলো জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ সদস্যদের ভোটে থানা পরিষদ গঠিত হবে। তবে থানা পরিষদের প্রশাসক/চেয়ারম্যান ও জেলা গভর্ণর জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। থানা প্রশাসক/চেয়ারম্যানরা ও জেলা গভর্ণররা জনগণ, স্ব স্ব পরিষদ ও প্রেসিডেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন। গ্রাম সমবায় পরিষদ থানা পরিষদের কাছে, থানা পরিষদ জেলা পরিষদের কাছে দায়ী থাকবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ, থানা পরিষদ, জেলা পরিষদ- এরপরই থাকবে জাতীয় সরকার। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে জাতীয় সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতাকে বিপুলভাবে বিকেন্দ্রিকরণ করে প্রশাসনকে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র, স্টিলফ্রেম গতানুগতিক বা টাইপড চরিত্রকে ভেঙ্গে গুড়ো করে দেবার ব্যবস্থা নিয়েছি। সরকারী কর্মচারীরা এখন থেকে জনগণের সেবক।
বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে রাজধানীতে বহাল রেখে হাইকোর্ট বিভাগকে আটটি আঞ্চলিক বিভাগে বিকেন্দ্রিকরণের ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে সুপ্রিমকোর্টের অধিবেশন বছরে অন্তত একবার করে প্রতিটি আঞ্চলিক বিভাগে (হাইকোর্ট) বসবে। জেলা আদালতসমূহ বহাল থাকবে। প্রতিটি থানাতে থাকবে একাধিক বিশেষ ট্রাইবুনাল। প্রত্যেকটি আদালতে যে কোনো মামলা ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মিমাংসা করতে হবে। গ্রামে থাকবে একাধিক শালিস বোর্ড। শালিস বোর্ড গঠিত হবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। শালিস বোর্ড চেয়ারম্যান থাকবেন সরকার নিয়োজিত বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা। এভাবে সুষ্ঠু, ন্যায় ও দ্রুততর গণমুখী বিচারকার্য সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিকরণ করা হয়েছে।
আবীর আহাদ : বঙ্গবন্ধু, অনেকে বলেন, আপনি নাকি কোনো একটি পরাশক্তির চাপের মুখে বা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাকশাল কর্মসূচী দিয়েছেন এবং এ ব্যবস্থা নাকি সাময়িক কালের জন্য করেছেন- এ বিষয়ে আপনি অনুগ্রহ করে কিছু বলবেন কি?
বঙ্গবন্ধু : কারো প্রেশার বা প্রভাবের নিকট আত্মসমর্পন বা মাথা নত করার অভ্যাস বা মানসিকতা আমার নেই। এ কথা যারা বলেন, তারাও তা ভালো করেই জানেন। তবে অপপ্রচার করে বেড়াবার বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই, তাই উনারা এ কাজে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। করুন অপপ্রচার। আমি স্বজ্ঞানে বিচার বিশ্লেষণ করে, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে, আমার দীনদুখী মেহনতী মানুষের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে আমি বাকশাল কর্মসূচী দিয়েছি। আমি যা বলি, তাই করে ছাড়ি। যেখানে একবার হাত দেই সেখান থেকে হাত উঠাই না। বলেছিলাম এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো, মুক্ত করেছি। বলেছি শোষণহীন দুর্নীতিমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলা গড়বো, তাই করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ। কোনো কিন্তুটিন্তু নাই, কোনো আপোষ নাই।
আবীর আহাদ : বঙ্গবন্ধু, বাকশাল বিরোধীমহল অর্থাৎ ঐ ৫% সংখ্যায় অতি নগণ্য হলেও তাদের হাতেই রয়েছে বিপুল সম্পদ। তাদের সাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী শক্তির যোগসাজশ। তাদের পেইড এজেন্টরাই রয়েছে প্রশাসনিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার কেন্দ্রে। তাদের কায়েমী স্বার্থের উপর আপনি আঘাত হানতে যাচ্ছেন, এই অবস্থায় তারা চোখ মেলে, মুখ গুজে বসে থাকবে বলে আপনি মনে করেন? তারা তাদের অবস্থান নিরাপদ ও সংহত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে না?
বঙ্গবন্ধু : আমি জানি তারা বসে নাই। ষড়যন্ত্র চলছে। প্রতিদিনই ষড়যন্ত্রের উড়ো খবর আমার কাছে আসে। সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহীরা এসব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। গোপন পথে অঢেল অর্থ এ কাজে লাগাবার জন্য বাংলাদেশে আসছে। সুকৌশলে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চলছে। অপপ্রচার চলছে। আমি জাতির বৃহত্তর কল্যাণে এ পথে নেমেছি। জনগণ সমর্থন দিচ্ছে। তাই ষড়যন্ত্র করে, বাধার সৃষ্টি করে, হুমকি দিয়ে আমাকে নিবৃত্ত করা যাবে না। আমার কাজ আমি করে যাবোই। হয়তো শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। পরোয়া করি না। ও মৃত্যু আমার জীবনে অনেকবার এসেছে। একসিডেন্টলি আজো আমি বেঁচে আছি। অবশ্যই আমাকে মরতে হবে। তাই মৃত্যু ভয় আমার নেই। জনগন যদি বোঝে আমার আইডিয়া ভালো, তাহলে তারা তা গ্রহণ করবে। আমার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবে। আমার একটা বড় সান্তনা আছে, যুদ্ধের সময় আমি জনগনের সাথে থাকতে পারিনি। জনগণ আমারই আদেশ ও নির্দেশে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। আজকের এই শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্র বা অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লবে আমি যদি নাও থাকি, তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার বাঙালীরা যে কোনো মূল্যে আমার রেখে যাওয়া আদর্শ ও লক্ষ্য একদিন বাংলার বুকে বাস্তবায়িত করে ছাড়বে ইনশাল্লাহ।
পরিশেষে , শোকাবহ আগস্ট মাসে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। নিষ্ঠুর আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহীদের স্মৃতির চরণে নিবেদন করছি বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য। সব হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক:
ইয়াসির আরাফাত-তূর্য ,
সাংগঠনিক সম্পাদক ,
বাংলাদেশে ছাত্রলীগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: