মহাভারতে সাবিত্রী, রামায়নে সীতা, মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা কিংবা পল্লীবাসিনী নারী -এদের মধ্যে বিত্তবৈভবের পার্থক্য থাকলেও একটা বিষয়ে সবার মধ্যে দারুণ মিল ছিল।মিলটি হলো তাদের প্রাচুর্য। এই প্রাচুর্য ছিল দুঃখ -যন্ত্রণা,বঞ্চনার প্রার্চুয।সামিয়া চৌধুরীর একটি গানের কথা দিয়ে শুরু করা যায়-
আমি কেন আসলাম ভবে
নারী জনম লইয়া
চিরদিন পরের অধীন পরের স্বাধীন গো
সদাই থাকি পরের মন জুগাইয়া
নারী জনম লইয়া।
গানটির উপজীব্য হলো নারী চিরদিনই অরাধীন,পরাশ্রয়ী ও পরনির্ভরশীল। সবসময় তাকে অন্যের মন জুগিয়ে চলতে হয়,নিজের মনের খবর নেওয়ার সময় বা সুযোগ কিছুই থাকেনা ফলে নারী সবসময় পরাধীন ও নির্যাতনের শিকার হয়।সুপ্রাচীন কাল থেকে নারীকে শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে দূর্বল ভাবা হয়ে থাকে।বঙ্গদেশে নারী যে আঠারো বা উনিশ শতকে অধস্তন ছিল এটা ভাবা ঠিক নয় নারী যে অধস্তন ও ভোগবিলাসের, নির্যাতনের শিকার এখনও বর্তমান সমাজে বিদ্যমান।
বাংলাদেশের প্রান্তীয় অঞ্চলের গরিব কন্যা শিশু শুধু তার ঘরের কোণে অন্য "পুরুষরুপী" কামীর ললসার শিকার হচ্ছে না বরং হলিউডের নামীদামি তারকাদের একই পরিনীতি বরণ করে নিতে হচ্ছে।এই ধরনের ঘটনা ঘটছে ও ঘটে চলছে।গত দুই দিন আগে দেশের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার দিকে আমরা একটু লক্ষ করি কি দেখতে পেলাম।রাত সাড়ে নয়টায় নিজ ক্যাম্পাসে পাঁচ তরুনের হাতে এক ছাত্রী যৌন নিপিড়ন ও মারধরের শিকার হন।বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় ওই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করেন সেই পাঁচ তরুন।একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জ্ঞান তৈরির কারখানা।যেখানে ছাত্ররা শিল্পসংস্কৃতির চর্চা,রাজনৈতিক চর্চা, অর্থনৈতিক, মানসিক চর্চার মাধ্যমে তাদের মেধা ও মননশীলতার সমৃদ্ধি করবে এবং দেশের প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি পরির্বতনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় নারী সন্মান না পায় তাহলে কোথায় পাবে প্রশ্নটি রয়ে গেল আমাদের নিকট।আমরা যদি যৌন হয়রানির প্রকৃত চিত্র দেখি তাহলে আমাদের কপালে ভাঁজের চিত্র প্রদর্শিত হবে।
প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দেশের রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন জনসমাগম স্থলে ৮১.৬ শতাংশ নারী যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হন তবে এসব ঘটনায় মামলা হচ্ছে ৩% এর নিচে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন,হয়রানি ও ব্যঙ্গবিদ্রুপের শিকার হয় ৭৪ শতাংশ নারী।অললাইন প্লাটফর্মে অশালীন, ক্ষতিকর মন্তব্যের মাধ্যমে নিপিড়নের ঘটনা ঘটেছে ৫৭ শতাংশ নারী।কর্মক্ষেত্রে যৌন-হয়রানির শিকার হচ্ছে ৫৬ শতাংশ নারী।জনসমাগমস্থলে সহিংসতার শিকার ৭৪.৪% নারী মানসিক বিষাদে ভোগেন,পারিবারিক বলয়ের সহিংসতার ভয়ে ৮০ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে ভয় পাই,শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহিংসতার শিকার ৯০ শতাংশ ছাত্রী মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং হতাশায় স্কুল, কলেজ বন্ধ করে দেয়।এই রির্পোটগুলো নারীর প্রতি পুরুষের আচরণের বাস্তবতা তুলে ধরে। আমাদের দেশ উন্নত হচ্ছে, দেশের সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু আমরা কেন এখনও নারীর প্রতি পুরুষ-তান্ত্রীক মনোভাব পরিবর্তন করতে পারলাম না।কেন আমরা নারীর জন্য একটি নিরাপদ সমাজ দিতে পারতেছিনা যার অন্যতম কারন পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব ও যৌন শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, মুল্যবোধ,নৈতিক শিক্ষার অভাব।।যদি আমরা শৈশব থেকে শিশুদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শিক্ষা ও আচরণের শিক্ষা দিতে হবে যাতে পুরুষ নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে কখনও নারী হিসেবে না।নারী যে কেমল কামনা, লালসা ও ভোগের জন্য নয় এই সামগ্রিক ধারনা পরিবর্তন করতে হবে।আমাদের উচিত নারী যে সাধনা, ভক্তি, সৌন্দর্য্য,আর্দশের প্রতিক সেই ধারনা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া এবং সেটা সম্ভব নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে। এই ক্ষমতায়ন যান্ত্রিক নয় বরং মানুষের অন্তগত অনিবার্য রুপান্তরের পরিণিতি যার ফলে নারী ও পুরুষ কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে পরস্পরকে সৃষ্টিশীলভাবে আবিস্কার করতে পারবে।নারী হবে পুরুষের সাধনার সঙ্গী, পুরুষ হবে নারীর ভক্ত ও দাস।ভক্ত রুপে হাজির থেকে পুরুষ প্রকৃতির মাঝে সহজ মানুষ হিসেবে হাজির থাকবেন এবং তার কামী সত্তার লোপ ঘটবে এবং মনোভাবের পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ হবে সুন্দর ও মনোরম।
লেখক
ইমরুল কবির
প্রভাষক ও উন্নয়ন গবেষক
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,জামালপুর -২০১২।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: