উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্কোয়াশ চাষে সফল হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ শুভ। তিনি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই গেল বছর নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) কৃষি বিভাগ থেকে বিএসসি শেষ করেন তিনি। লকডাউনের কারণে পরিবারের সঞ্চয় করা অর্থ তখন প্রায় শেষের দিকে। পরিবারে অর্থনৈতিক মন্দা, টানাপোড়েন। ভাবলেন বসে না থেকে কিছু একটা করা উচিত।
লকডাউন শিথিলের পর বেসরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা শুরু করেন। লকডাউন শিথিল হলেও করোনা দুর্যোগে তখন বেসরকারি সেক্টরগুলো তখন সংকটে। আবেদনের পর কয়েকটি মার্কেটিং কম্পানি এবং প্রাইভেট হসপিটালের অ্যাডমিন শাখা থেকে ভাইভার জন্য ডাক পান তিনি। ভাইভা শেষে বেতন, কাজের চাপ এবং সময় সম্পর্কে জানার পর ভাবলেন বিএসসি শেষ করে চাকরিতে প্রবেশ করে খুব বেশি আরাম কিংবা একটু ভালো বেতন আশা করা অবাস্তব। এরপর চাকরির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে নিজ সাবজেক্ট সম্পর্কিত কিছু করার মনস্থির করেন, যেখানে তিনি নিজে কাজ করবেন এবং অন্তত দুজন লোক তার সঙ্গে কাজ করে উপকৃত হবে।
লকডাউনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’। কৃষি বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের বসতবাড়িতে সবজি চাষ এবং পারিবারিক পুষ্টি চাহিদার প্রজেক্ট নিয়ে বাসায় কাজ করে সাফল্যের দেখা পান শাকিল। পূর্বের প্রজেক্টের সাফল্য আর স্নাতকের থিসিস তত্ত্বাবধায়ক কৃষিবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. গাজী মোহাম্মদ মহসিনের তত্ত্বাবধানে সবজি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বড় পরিসরে কিছু করা যায় কি না সে লক্ষ্য সামনে রেখে ইন্টারনেট এবং ইউটিউবে সার্চ করতে শুরু করেন বাণিজ্যিকভাবে কি চাষ করা যায়। ইউটিউবে কৃষি সমাচার চ্যানেলের ভিডিও থেকে তিনি শীতকালীন সবজি স্কোয়াশ চাষ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে শাকিল তার বাবাকে জানান। এতে তার বাবা রাজি হন এবং চাষাবাদের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। বাবার আশ্বাস পেয়ে চিন্তা করেন ভিন্ন উপায়ে চাষাবাদ করার। কম পরিশ্রমে অধিক ফলনের লক্ষ্যে ভারত থেকে আনা উন্নত প্রযুক্তির মালচিং ফ্লিম দিয়ে চাষাবাদ করেন তিনি। ফলে জমিতে অতিরিক্ত কোনো শ্রমিকের প্রয়োজন পড়েনি, পরিচর্যার জন্য মাটির আর্দ্রতাও ঠিক ছিল, সেচের প্রয়োজন পড়েনি।
বাণিজ্যিক চাষাবাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভালো বীজ এবং সঠিক জাত নির্বাচন করা। এ ব্যাপারে আবার ইন্টারনেট এবং ইউটিউবে সার্চ করার পর যারা এর আগে স্কোয়াশ চাষ করেছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোরিয়া থেকে আমদানি করা বীজ বেছে নেন। রোপণকৃত মোট দুই হাজার ২০০টি স্কোয়াশ গাছ থেকে লক্ষাধিক টাকার সবজি বিক্রি করেছেন শাকিল। যেখানে তার খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা।
কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ বলেন, স্কোয়াশ একটি স্বল্পমেয়াদি শীতকালীন সবজি হওয়ায় পুরোদস্তুর ফুল ফোটা শুরু হয় ৩১-৩৬ দিনের মধ্যেই এবং ফল উত্তোলন করা যায় ৪১ দিন থেকেই এবং গাছের বয়স ৮৫-৯০ দিন পর্যন্ত ফল উত্তোলন করা যায়। এর একটি গাছে ৮ -১০টা পুরুষ ফুল হয় এবং ১২-১৪টা পর্যন্ত স্ত্রী ফুল হয় এবং ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে একটি গাছ থেকে ৮-১২টি ফল উত্তোলন করা সম্ভব। আমি গড়ে ৭০০-৯০০ গ্রামের ৮টি ফল উত্তোলন করতে পেরেছি। আমার মোট ২২০০ গাছ থেকে লক্ষাধিক টাকার সবজি বিক্রি করেছি। মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫,০০০ টাকা।
তরুণ এই কৃষিবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জমিতে বীজ বপন করে স্কোয়াশ চাষাবাদ করা যায়। তবে উত্তম সময় হচ্ছে ১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। এটি দক্ষিণ আমেরিকার জনপ্রিয় একটি খাদ্য। বর্তমানে জাপান, চীন, রোমানিয়া, ইতালি, মধ্যপাচ্য, তুরস্ক, মিসর এবং আর্জেন্টিনার বাসিন্দারা চাষের মাধ্যমে এর উৎপাদন করেন। গবেষকদের মতে, স্কোয়াশের ত্বকেই থাকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পুষ্টি। এটি পানি, ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ফোলেট এবং বিটা ক্যারোটিনের একটি দুর্দান্ত উৎস। স্কোয়াশ এমন একটি উদ্ভিদ যা সারা বছরই পাওয়া যায়। এটি উদ্ভিদগতভাবে একটি ফল হিসেবে বিবেচিত হলেও মসৃণ ত্বক, ছোট বীজ এবং মাংসল শাঁসের জন্য এটিকে সবজি হিসেবে গণ্য করা হয়। জুকিনি, কোর্জেট(Courgette) স্কোয়াশ নামেও পরিচিত।
সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী উপায়ে মালচিং ফ্লিম চাষাবাদ করতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা এবং সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে কৃষিবিদ শাকিলকে। তিনি বলেন, মালচিং ফ্লিম দিয়ে চাষাবাদ করতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। আশেপাশের গ্রামসহ আমার পুরো এলাকাতে মালচিং পেপার দিয়ে চাষাবাদ পুরোপুরি নতুন ধারণা। আগে কখনো তারা এটি দেখেনি। এটা সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা না থাকায় আমি আমার জমিতে দেয়ার পর সবাই সমালোচনা করতে শুরু করে করিম মিলিটারির ছেলে ভার্সিটি থেকে পাশ করে এসে কি নাকি বিদেশি সবজি চাষ করবে পুরো জমি পলিথিন দিয়ে ঢেকে ফেলছে এ জমিতে এসব হবে নাকি ভার্সিটি পাশ কইরা এসে পাগল হয়ে গেছে। কৃষক হইতে আসছে। সকল কটু কথাসহ সব কিছু সহ্য করে গেছি পরিবারের সাপোর্ট ছিলো বলে আজকে যখন আমি সফলতা অর্জন করেছি এবং তারা মালচিং পেপারের উপকারিতা লক্ষ্য করেছে এখন তারা নিজেরাও এটা সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছে এজন্য আমার ভালোলাগা কাজ করে। এতে করে নতুন একটা প্রযুক্তি সম্পর্কে পরিচিতি এবং সেটার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে।
শাকিল আহমেদ জানান, কৃষি নিয়ে পড়াশোনাটা ছিল তার প্যাশন। করোনায় গ্রামে যার যার বাড়িতে ফাঁকা জমি ছিল সবাইকে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি এবং নিজ থেকে বীজ এবং পরামর্শ দিয়েছেন। তার গ্রামে সবসময় সবাই এক ফসল করতেন এর আগে। ধান চাষাবাদ ছাড়া তারা অন্যকিছু করেননি। স্থানীয় কৃষকদের বুঝিয়ে কয়েকটি উঠান বৈঠক করে আলু এবং ভুট্টা চাষে উদ্ধুদ্ধ করেছেন তিনি। গ্রামের অনেক কৃষক এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে জমিতে আলু এবং ভুট্টা চাষ শুরু করেছেন। তার স্কোয়াশ প্রজেক্ট দেখে গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষক স্কোয়াশ চাষে আগ্রহী হয়েছেন। তাদের নানা পরামর্শ দেওয়াসহ উপজেলা কৃষি সম্প্রারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে তার কাজে সাহায্য করেছেন তিনি। কৃষককে উন্নত কৃষি ব্যবস্থায় আগ্রহী করতে ধানের জন্য লাইন, লোগো,পার্চিং (এলএলপি) পদ্ধতিতে সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করেছেন। এ ছাড়া নিজ স্কোয়াশ জমিতে মালচিং পেপারসহ কেমন ফলন হয়, খড়, কচুরিপানা দিয়ে মালচিং করলে কেমন ফলন হয় এবং মালচিং ছাড়া কেমন ফলন হয় সেটা নিয়ে এক গবেষণাও করেছেন তিনি।
কৃষকদের উদ্দেশে শাকিল বলেন, কোনো কৃষক মালচিং পেপার ছাড়া চাষ করতে চায় তার জন্য পরামর্শ থাকবে অন্তত খড় দিয়ে মালচিং করে দিন ফলন ভালো হবে। স্কোয়াশ চাষাবাদ সম্পর্কে তিনি বলেন, স্কোয়াশ বাংলাদেশে নতুন হলেও বিদেশে এর প্রচুর চাহিদা। বাংলাদেশে সবজির বাজারে প্রবাসীরাই এর মূল্য ক্রেতা। তারা এর স্বাদ সম্পর্কে জানে এজন্য অনেকেই সরাসরি জমিতে এসে আমার সবজি কিনে নিয়ে যায় তখন ভালোলাগে অনেক। আশা করছি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এর ব্যাপক সম্প্রসারণ হবে এর স্বাদ এবং পুষ্টিগুণ সম্পর্কে মানুষ জানবে এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ একান্ত কাম্য।
গ্রামীণ কৃষি নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে কাজ করার স্বপ্ন শাকিলের। তিনি বলেন, কৃষি নিয়ে বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষি নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছে আমার। আমি এবং তিন-চারজন বন্ধু মিলে এই কাজটি করতে চাই। কিভাবে কম খরচে অধিক ফসল উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি দালাল, ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের নিকট কিভাবে বিপণন করা সেটা নিয়েও কাজ করব।
শাকিলের স্কোয়াশ প্রজেক্ট পরিদর্শন করেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোনমি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম সাঈদুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, এটি একটি নতুন উদ্ভাবন। শাকিলের সম্ভাবনাময় প্রজেক্ট দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তরুণ কৃষিবিদ শাকিলের গ্রামে গিয়ে নিজের অর্জিত শিক্ষা থেকে নতুন কিছু করেছে বিষয়টি আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। কৃষি বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহের উৎস। এভাবে কৃষির সঙ্গে তরুণ কৃষিবিদরা মাঠপর্যায়ে গেলে গ্রামীণ কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. গাজী মোহাম্মদ মহসীন বলেন, স্কোয়াশ মিষ্টিকুমড়া গ্রুপের একটি ফসল। এর পুষ্টিমাণ অনেক বেশি। শাকিল আমার সঙ্গে থিসিসের কাজ করে কিভাবে স্বল্প সময়ে বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদন করা যায়, যা কৃষকদের জন্য লাভজনক সে বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে এবং করোনাকালে সে বসে না থেকে গ্রামে গিয়ে গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করেছে এবং সে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে। তার সাফল্য দেখে স্থানীয় কৃষকরাও উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
এই বিভাগের অন্যান্য খবর
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: