অদম্য জান্নাতুল ফেরদৌসের গল্প 

সুদীপ চাকমা | ৭ জানুয়ারী ২০২৪, ১৩:৫০

অদম্য জান্নাতুল ফেরদৌসের গল্প 

একবিংশ শতকে এসে কোন প্রতিবন্ধকতায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি নারীদের সামনে। তারা দৃঢ়চেতা মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তাদের আপন লক্ষ্যে। তাই বিংশ শতকে কাজী নজরুল ইসলাম তার 'নারী' কবিতার শেষ উক্তিটিতে বলেছেন 'সেদিন সুদূর নয়-যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!'

ঠিক তেমনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস। যিনি সকল প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে চালিয়ে যাচ্ছেন তার পড়াশোনা।  

 
জন্মের পর ভুল চিকিৎসার জন্য হারিয়েছেন শ্রবণ শক্তি, কানে মেশিন লাগিয়ে শুনেন কোনরকম   সেই সাথে কথাও বলতে পারেন না ঠিকমত। তবুও এই প্রতিবন্ধকতাগুলোকে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি তার এগিয়ে চলার পথে। কথা স্পষ্ট ভাবে বলতে না পারায় যোগাযোগ করেন মোবাইলে লিখে। স্বপ্ন তার গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা। পাশাপাশি কাজ করতে চান প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে। 
 
তার বাড়ী কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামে। বাবা মোঃ সহিদুল ইসলাম পেশায় একজন চাকরীজীবি। মা খাদিজা আক্তার পেশায় একজন শিক্ষিকা। পরিবারের তিন বোনের মধ্যে সবার বড় জান্নাতুল। তিনি পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছেন জিপিএ-৫। কুমিল্লার সরকারি মহিলা কলেজ থেকেও এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পেয়েছেন জিপিএ-৪.৩৩। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। 
 
স্বপ্ন ছিল তার মেডিকেলে পড়ার। ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে ডেন্টালের ভর্তি পরীক্ষায় ৭৫.২৫ নম্বর পেয়ে বেসরকারি এক ডেল্টাল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু শ্রবণ প্রতিবন্ধী হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি পরীক্ষায় ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে হয়েছেন ৩৫০ তম। 
 
শুধু তাই নয় শিক্ষার্থীর বাইরেও তিনি এক ছেলের মা। বিয়ের পরপরই তার কোলজুড়ে আসে এক পুত্র সন্তান তখন তিনি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তাই সেই বছর চালিয়ে যেতে পারেননি তার পড়াশোনা। বর্তমানে পারিবারিক সমস্যার কারণেও থাকেন স্বামীর সাথে আলাদা। তারপরও এই সকল বাঁধাকে মোকাবেলা করে পুনরায় ভর্তি হয়েছেন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। এখন ক্লাসের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে তাল মিলিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন তার পড়াশোনা। অনেক সময় দেখা যায় রুগ্ন দেহ দিয়ে কোলে করে তার শিশু সন্তানকে নিয়ে আসেন ক্লাসে।  
কিভাবে সামলাচ্ছেন একজন মেয়ে, শিক্ষার্থী ও মা এই তিন রুপ জানতে চাইলে তিনি মোবাইলে লিখে বলেন, ' জন্মের সময় আমার কানের পর্দা নষ্ট হয়, এজন্য দুই কানে শুনিনা। ঢাকার মহাখালী হাসপাতালে ডাক্তার দেখাই। ৬ বছর বয়সে কানে মেশিন ব্যবহার করি তখন থেকে অস্পষ্ট করে কথা বলা শুরু করি। পড়াশুনার হাতেকড়ি বাবা মার হাত ধরে। এখনও পর্যন্ত সবকিছু পরিবার, বান্ধবী ও ডিপার্টমেন্টের সহযোগিতায় সামলাচ্ছি। অনেক সময় মনে হয় ভার্সিটি ছেড়ে দেই। '
 
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দীন বলেন, ' বাংলাদেশে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আজও নানা ধরণের সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কারণ আমরা এখনও আমদের শিক্ষাক্ষেত্রকে সার্বজনীন করতে পারিনি। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষায় যারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, পক্ষাঘাতগ্রস্থ বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা যাদের রয়েছে তাদের নির্দিষ্ট কোন পড়াশোনার পদ্ধতি না থাকাই দুই একজন ব্যতিক্রমী ব্যতীত মেধা থাকা সত্ত্বেও চালিয়ে যেতে পারেন না তাদের পড়াশোনা। এছাড়াও আমরা অনেক সময় আমাদের মনের অজান্তেই তাদেরকে শারীরিক ও মানসিক আঘাত দিয়ে ফেলি। তার জন্য আমাদের চোখ কান খোলা রাখতে হবে এবং আমরা সবসময়ই চেষ্টা করবো তাদের সম্মান রক্ষা করে তাদের সহযোগিতা করার।'


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: