বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে ৬ আন্তর্জাতিক সংগঠনের উদ্বেগ

সময় ট্রিবিউন | ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১:২৪

বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে ৬ আন্তর্জাতিক সংগঠনের উদ্বেগ

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছে ৬টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন। মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) রবার্ট এ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস-এর ওয়েবসাইটে এক যৌথ বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানান হয়।

সংগঠনগুলো হলো- রবার্ট এ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস (আরএফকেএইচআর), ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট (সিপিজেপি), দ্য ইউনাইটেড এগেইনস্ট টর্চার কনসোর্টিয়াম (ইউএটিসি), এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ান্সেস (এএফএডি), এন্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক (এডিপিএএন) এবং ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন এগেইনস্ট এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস (আইসিএইডি)।

বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং নাগরিক সমাজের স্থান সংকুচিত হয়ে আসছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে এবং মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখায় ব্যবস্থা নিতে।


গত ২৮ অক্টোবর বিরোধীদের দমন করতে সহিংসতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, এ বছর অক্টোবরের শেষের দিক থেকে রাজনৈতিক বিরোধীদের সমন্বিত র‌্যালি ও প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। এসব প্রতিবাদকারী ও রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীকে দমন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সহিংসতা ফিরিয়ে এনেছে। এই দমনপীড়নে একজন সাংবাদিকসহ ১৭ জনকে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন বিরোধী দলের ৮২৪৯ জন নেতা। এছাড়াও হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আয়োজিত মানববন্ধনে পুলিশ, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছেন।

এসব ঘটনায় জরুরিভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো করেছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়।

সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং অতিমাত্রায় কাঁদানে গ্যাস, লাঠি, লাঠিপেটা, রাবার বুলেট ব্যবহার এবং একই রকম অন্যান্য ব্যবস্থার ব্যবহার উদ্বেগকে গুরুতর করে তুলেছে বলে বিবৃতিদাতারা মনে করেন।

এতে বলা হয়, পুলিশের এসব অস্ত্রের অপব্যবহার মোকাবিলায় অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এসব অস্ত্রের অযৌক্তিক ব্যবহার শুধু নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকারই লঙ্ঘন করে এমন নয়। একই সঙ্গে উত্তেজনাকে বৃদ্ধি করে। সৃষ্টি করে এমন একটি পরিবেশ, যা ভিন্নমতাবলম্বী, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং গণতান্ত্রিক আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জরুরি ভিত্তিতে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের ‘বেসিক প্রিন্সিপালস অন দ্য ইউজ অব ফোর্স অ্যান্ড ফায়ারআর্মস বাই ল এনফোর্সমেন্ট অফিসিয়ালস’ এবং জাতিসংঘের ‘হিউম্যান রাইটস গাইডেন্স অব লেস-লেথাল উইপন্স ইন ল এনফোর্সমেন্ট’।

‘অক্টোবরের শেষ দিকে বাংলাদেশ সরকার গণহারে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে আটক করেছে, যারা বিরোধী দলের বা বিরোধী দলের সমর্থক হিসেবে মনে করা হয়। ৮৩৪টি মিথ্যা মামলার অভিযোগে এসব গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৈধ প্রেক্ষাপট থাকা সত্ত্বেও অব্যাহতভাবে এসব মামলায় জামিন অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। যথাযথ প্রক্রিয়ার নিশ্চয়তাকেও বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতনের এই অভিযোগ শুধু গত মাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আগেও একই রকম অভিযোগের প্রতিবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রহার, বৈদ্যুতিক শক, ওয়াটারবোর্ডিং, ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করে দেয়ার মতো দৃশ্য তৈরি করা- হাঁটুর নিচে গুলি করা, ভুয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দৃশ্য তৈরি করা এবং জোরপূর্বক নগ্ন করা’ বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

গণহারে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অভিযুক্ত করতে সরকার বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের হেভিওয়েট প্রার্থীদের অযোগ্য করতে রাতেও আদালতে বিচার করছ

এগুলো কয়েক মাস আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছে। গণহারে এই আটক এবং অভিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত সততা এবং সুষ্ঠু বিচারের অধিকারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে এমন না। একই সঙ্গে পুরো পরিবারকে সীমাহীন হতাশায় ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই আটক ব্যক্তি তার পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়।

সহিংসতা ও নির্বিচারে আটক বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অবস্থার এক ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, জনগণ আগামী মাসে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করছে যখন, তখন এসব নির্যাতন করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের মৌলিক মূলনীতিকে সমুন্নত করার পরিবর্তে বাংলাদেশ সরকার সহিংস ও দমনপীড়নের মতো পদক্ষেপ ব্যবহার করছে। তাতে ভয়, উদ্বেগ এবং নাগরিকদের জন্য চরম অনিরাপদ এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এই সহিংস দমনপীড়নের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন- ‘বাংলাদেশ যেহেতু ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন রাজনৈতিক সহিংসতা, বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার, কয়েক হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার, কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, আন্দোলনে ব্যাঘাত ঘটাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া, প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আটক ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদেরকে হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও বেআইনি আটকের ঘটনা বৃদ্ধিতে তারা গভীরভাবে হতাশ বলে জানায় বিবৃতিতে।

এছাড়াও বিবৃতিতে ডাটা সুরক্ষা আইনকে আরেকটি উদ্বেগের বিষয় বলে দাবি করা হয়েছে। এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নাগরিকের ডাটায় বাধাহীন প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে। যদি জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিরোধ অথবা কোনো অপরাধ শনাক্ত হয় বলে মনে হয়, তখনই তারা এটা ব্যবহার করতে পারবে। এই ক্ষমতার অপব্যবহারে ব্যাপক বিস্তৃত নজরদারি সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের। এর ফলে মানবাধিকার, বিশেষ করে ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্যের বিষয়ে হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যেসব ক্ষেত্রে এসব ডাটা সংগ্রহ করা হবে এবং ডাটার সুযোগ প্রয়োজন হবে- তা পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। এসব ক্ষেত্রে সময়োপযোগী নিরপেক্ষ বিচারিক পর্যালোচনা প্রয়োজন।

সহিংসতা, নিপীড়ন, রাজনৈতিক বিরোধীদের ভীতি প্রদর্শন অবিলম্বে বন্ধ রাখার জন্য বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিবৃতি স্বাক্ষরকারী সংগঠনগুলো চারটি সুপারিশ তুলে ধরেছে। এতে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

সুপারিশগুলো হলো :

*অবিলম্বে প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা, নিজের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত সততাকে যাতে সম্মান ও সুরক্ষিত রাখা হয়- তা নিশ্চিত করতে হবে।

*অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে সব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আটক অধিকারকর্মী এবং বিরোধী দলের সদস্যদের মুক্তি দিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়া।

*মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্ণাঙ্গ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। এর মধ্যে থাকবে মৃত্যু এবং নির্যাতনের অভিযোগগুলোও।

*আন্তর্জাতিকমানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডাটা সুরক্ষা আইনের খসড়াকে পুনর্মূল্যায়ন এবং রিভাইস করতে হবে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: