শিশুস্বাস্থ্য, মাতৃস্বাস্থ্যে উন্নতির ফলে গড় আয়ু বাড়ে। ৫০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের আছে গুরুত্বপূর্ণ নানা অর্জন। বাংলাদেশ পেছনে ফেলেছে অনেক দেশকে।
দেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু এখন ৭২ বছর ৭ মাস। ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬ বছর। ৫০ বছরে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ২৬ বছর ৭ মাস। স্বাধীনতার পর প্রতি এক বছরে এ দেশের মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল প্রায় ছয় মাস করে বেড়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি। মানুষ বেশি দিন বাঁচতে চায়। এখন এ দেশের মানুষের বেশি দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়েছে।
পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক তৌফিক জোয়ারদার বলেন, গড় আয়ু স্বাস্থ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক। শিশুস্বাস্থ্য, মাতৃস্বাস্থ্য, পুষ্টি পরিস্থিতি, মোট প্রজনন হার—এ ধরনের বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে ভালো করেছে বলে গড় আয়ু বেড়েছে।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি মালদ্বীপের মানুষের। দেশটির মানুষের গড় আয়ু ৭৮ বছর। এরপর মানুষ বেশি বাঁচে শ্রীলঙ্কায়, ৭৬ বছর। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তানের মানুষের চেয়ে বেশি দিন বাঁচে।
এখন থেকে ৫০ বছর আগে পরিস্থিতি এমন ছিল না। বিশ্বব্যাংক ১৯৬০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের দেশগুলোর গড় আয়ুর হিসাব দিয়েছে তাদের ওয়েবসাইটে। তাতে বাংলাদেশের উন্নতি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ পাকিস্তানকে বহু পেছনে ফেলেছে। এটা সম্ভব হয়েছে এ দেশের স্বাধীনতার কারণে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৩ বছর। ওই সময় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬ বছর। অর্থাৎ পাকিস্তানের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৭ বছর কম ছিল। এটি ছিল একই দেশের দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যকার বৈষম্য।
একাত্তরের পর পরিবর্তন শুরু হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় উন্নয়নে নিজের অগ্রাধিকার ঠিক করেছে, নিজের মতো করে পরিকল্পনা তৈরি করেছে, নিজের ইচ্ছা ও সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে, নিজের দক্ষতায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। স্বাস্থ্য পরিষেবার যে কাঠামো বাংলাদেশের আছে, তা বিশ্বের কম দেশেই দেখা যায়।
১৯৯৪ সালে এসে দেখা যায়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু সমান, ৬১ বছর। তখন থেকেই পেছনে পড়ে যায় পাকিস্তান। পাকিস্তানের গড় আয়ু এখন ৬৭ বছর। অর্থাৎ ২৭ বছরে গড় আয়ু বেড়েছে ৬ বছর। একই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ১১ বছর। ৫০ বছরে পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ১৪ বছর।
গড় আয়ু বাড়ার কারণ অপরিণত মৃত্যু কমে আসা। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুসহ অপরিণত বয়সে মৃত্যু কমে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের ওই একই হিসাব বলছে, ১৯৭১ সালে এক হাজার জীবিত শিশু জন্ম নিলে তাদের বয়স এক বছর হওয়ার আগেই ১৪৮টি শিশু মারা যেত। এখন মারা যায় ২৫টি শিশু। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো ছিল। তখন পাকিস্তানে ওই বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৩৯। এখন হার ৫৫। অর্থাৎ পরিস্থিতি বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ।
শুরু থেকেই বাংলাদেশ মাতৃস্বাস্থ্যে জোর দিয়েছে। স্বাধীনতার সময় একজন মা গড়ে ছয়টি সন্তানের জন্ম দিতেন। জোরালো পরিবার পরিকল্পনা সেবার কারণে মোট প্রজনন হার (টিএফআর) কমে এসেছে। এখন টিএফআর ২ দশমিক ৩। পাশাপাশি প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সেবার পরিধি ও মান বেড়েছে। এগুলো সরকারি শিশুস্বাস্থ্যে প্রভাব রেখেছে। তা ছাড়া শিশুর জীবন রক্ষায় নানা ধরনের টিকা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা পেয়েছে।
শুধু শিশুমৃত্যু নয়, বয়স্কদের মৃত্যুও ৫০ বছর আগের চেয়ে কমেছে। আগে এক হাজারের মধ্যে এক বছরে ১৯ জনের মৃত্যু হতো। এখন তা কমে পাঁচজনে এসে দাঁড়িয়েছে। স্থূল মৃত্যুহার (ক্রুড ডেথ রেট) কমে যাওয়ার কারণেও দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে।
বাংলাদেশের এই উন্নতি শুধু পাকিস্তানের তুলনায় হয়েছে, তা নয়। সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের তুলনাতেও বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ওপরে। এমনকি বৈশ্বিক গড় হিসাবেও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বৈশ্বিক গড় আয়ু ছিল ৫৯ বছর। বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে বৈশ্বিক গড় আয়ু ১৩ বছর বেশি ছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু বৈশ্বিক গড় আয়ুর চেয়ে ৭ মাস বেশি।
সংবাদ কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: