সমাজে ‘ধর্মান্ধতা’ বাড়ছে, প্রতিহত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে: রতন সিদ্দিকী

সময় ট্রিবিউন | ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২৩:০২

সংগৃহীত

ধর্মান্ধ-মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে প্রতিহত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র সঠিকভাবে পালন করছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন নাট্যকার অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী।

মঙ্গলবার রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশে তিনি বলেন, "যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাষ্ট্র গড়তে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছিল, সেই অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের দেখা এখনও দেশের মানুষ পায়নি। আমাদেরকে এখনো প্রতিবাদ করে যেতে হয়। আমরা প্রতিবাদ করে চলেছি। উগ্রবাদীদের আক্রমণ বাড়ছে, আর আমরা প্রতিবাদ করে চলেছি। রাষ্ট্রকে দায়িত্বশীল হয়ে এসব উগ্রবাদীদের রুখে দিতে হবে।”

সমাজে ‘ধর্মান্ধতা’ ছড়িয়ে পড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটাকে প্রতিহত করার জন্য রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্র যদি দায়িত্ব নিতে ভুল করে, তার পরিণাম কত ভয়াবহ হয়- আমরা সেই ইতিহাস জানি।”

নড়াইলে লালন সাধক হারেজ ফকিরের ওপর হামলা, মারধর, প্রাণনাশের হুমকি এবং সংগীত চর্চার উপকরণ তছনছ করার প্রতিবাদে বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ মঙ্গলবার শাহবাগে এই প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে।

সমাবেশে জানানো হয়, বাউল সাধকসহ সংস্কৃতিকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়ে শিগগিরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হবে৷

গত ১ জুলাই বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যকার অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকীর উত্তরার বাসাতেও একদল লোক হামলা করেছিল।

সমাবেশে তিনি বলেন, “আমাদের সমাজ ক্রমশ অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর বাংলাদেশকে যারা মিনি পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, তাদেরকে রুখে দিতে হবে।"

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, "প্রতিবাদহীনতার কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন বেড়েই চলেছে। যখন কোনো নাট্যকর্মী আক্রান্ত হন, তখন কেবল নাট্যকর্মীরা প্রতিবাদ করেন। যখন কোনো সংগীতশিল্পী আক্রান্ত হন, তখন কেবল সংগীতশিল্পীরা প্রতিবাদ করেন। অথচ আমরা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে পারি না। আমাদের সবাইকে এক হয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দিতে হবে।”

সারাদেশের সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী একটি জাতীয় সংস্কৃতি সমাবেশ আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান গোলাম কুদ্দুছ।

তিনি বলেন, “৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমাদের সংবিধানকে যেভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে উগ্রবাদী ধর্মীয় রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যে বাংলাদেশ হওয়ার কথা ছিল, সেটি আর হয়নি। রাষ্ট্র অসাম্প্রদায়িক না হলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না।”

সমাবেশে বক্তব্য দেন চারুশিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী, সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি তপন মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়, বাংলাদেশ বেতারের সাবেক মহাপরিচালক নারায়ণ চন্দ্র শীল, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, বাউল ও লোকশিল্পী সংস্থার সভাপতি হীরক রাজাসহ অনেকে।

উদীচীর অমিত রঞ্জন দে বলেন, “বাউল শিল্পীরা গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে গান করেন। মানুষের মানবিক বিকাশে ভূমিকা রাখেন। আমরা কথায় কথায় বলি, লালন-হাছনের দেশের মানুষ আমরা। হারেছ ফকির সেই লালন ফকিরের গান করে চলেছেন ৫০ বছর ধরে। এবার তার উপর আঘাত এসেছে। এর আগে সুনামগঞ্জে রণেশ ঠাকুরের বাড়িতে আগ্রমণ করা হয়েছে। একের পর এক বাউলের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে।

“হারেছ ফকিরের উপর যে আক্রমণ করেছে, সেই আলী মিয়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এই আলী মিয়ার মত অনেকে আওয়ামী লীগের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের যদি রুখে দেওয়া না যায়, তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ পথ হারাবে।”

সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় বলেন, “আওয়ামী লীগের শাষনামলে বেশ কিছু জায়গায় বাউলদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। রাজবাড়িতে ১৮ জন বাউলের চুল কেটে দেওয়া হয়েছে। একের পর এক হামলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি আশ্রয় নিয়ে এসব করে যাচ্ছে।”

বাউলদের ওপর কেন বার বার আক্রমণ করা হচ্ছে- সেই প্রশ্ন রেখে নিজেই উত্তর দেন বিশ্বজিৎ রায়।

তিনি বলেন, “বাউলরা মানবতার কথা বলে, এজন্য উগ্রবাদী-মৌলবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হচ্ছে। কারণ বাউলরা সক্রিয় থাকলে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে না। মৌলবাদী শক্তি জানে, যতদিন বাউলরা গানে গানে মানবতার কথা বলে যাবেন, ততদিন বাংলাদেশে তাদের জায়গা হবে না। তাদের বাউলদের কণ্ঠ থামিয়ে দিতে চায়। আমরা সেটা হতে দেব না।”

চারুশিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী বলেন, “প্রশাসনের ভেতরে বড় একটা অংশ সাম্প্রদায়িক। তারা বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র করছে। দেশব্যাপী পরিকল্পিত যে সাম্প্রদায়িক হামলা, সেটা তো প্রশাসন ও পুলিশের সামনেই ঘটছে৷ প্রশাসনের মধ্যে থেকে যারা সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”

গত ২৭ অগাস্ট নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পুরুলিয়া ইউনিয়নে লালনসাধক হারেজ ফকিরকে মারধর ও গালি-গালাজ করা হয়। সেদিন সন্ধ্যার পর পুরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম মণির অফিসে সালিশ বসে।

সালিশ শেষ হওয়ার পর রাত ১১টার দিকে ১০-১৫ জনের একটি দল পুরুলিয়া বাজে-বাবরা গ্রামে হারেজ ফকিরের ‘শরিফা বাউল আশ্রমে’ ভাঙচুর চালানো হয়।

ওই ঘটনায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন হারেজ ফকির। তার অভিযোগ, চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম মণির বড়ভাই মো. আলী মিয়া শেখের নির্দেশে চাচাতো ভাই মিন্টু শেখের নেতৃত্বে ওই হামলা হয়।

মিন্টু শেখ ও আমিরুল ইসলাম মণি হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। আর কালিয়া থানার ওসি তাসনিম হোসেন স্থানীয় সংবাদিকদের বলেছেন, পুলিশ তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: