বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা মামলার রায়ের পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি অমিত সাহার মা দেবী রানী সাহা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, “আমার ছেলে ঘটনার সময় ছিল না। সে নেত্রকোনার বাড়িতে যায়। তার অপরাধ সে ছাত্রলীগ করতো। গণমাধ্যমের চাপে আমার ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে জড়ানো হয়েছে। সে নাকি শুধু মেসেঞ্জারে কথা বলেছে, এজন্য যাবজ্জীবন! আশা করেছিলাম অমিত খালাস পাবে।”
বুধবার বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যায় ২০ আসামির ফাঁসির আদেশ ও বাকি ৫ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিচারক আবু জাফর মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের আদালত।
এদিকে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপর আসামি মুয়াজ আবু হুরায়রাও রায় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে। রায় শুনতে তার মা আদালতেই ছিলেন। মুয়াজ বুয়েটের ই-ই-ই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র। তার মা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মুয়াজ আবরারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। টাকা খরচ করে ওষুধ, স্যালাইন কিনেছে। তাকেই যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হলো।’
সাজাপ্রাপ্ত মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলামের বাবা মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে খুঁজে পুলিশে দিয়েছি। নিজে তাকে আত্মসমর্পণ করিয়েছি। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে এই রায় আশা করিনি। গণহারে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দেওয়া হলো। এতে আমরা হতবাক। এমন রায়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার আকস্মিকতায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কেউ পেশাদার অপরাধী না। সবাই মেধাবী শিক্ষার্থী। আমরা উচ্চ আদালতে যাবো।’
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। পরে একই দিন রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি।
এই হত্যার ঘটনায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের ১৯ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে ৭ অক্টোবর সংগঠনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে সাধারণ সম্পাদক রাসেলসহ বুয়েট শাখার ১১ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। একই অভিযোগে ১৪ অক্টোবর অমিতও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন।
১১ অক্টোবর বুয়েট প্রশাসন ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে। ২১ নভেম্বর হত্যা মামলায় সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে ২৫ শিক্ষার্থীকে বুয়েট থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের অধিকাংশই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
মামলার তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান।
অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৯ জন ও তদন্তে প্রাপ্ত আরও ৬ জন। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৭ জন ও এজাহারবহির্ভূত ৬ জনের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ৮ জন। এখনও পলাতক ৩ আসামি। পলাতকরা হলেন, মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মুজতবা রাফিদ। এদের মধ্যে প্রথম দুজন এজাহারভুক্ত এবং শেষের জন এজাহারবহির্ভূত আসামি।
২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। মামলায় মোট ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়।
উচ্চ আদালতে আসামিদের আপিল ও বিচারক করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণে একমাস করে মামলার কার্যক্রম স্থগিত ছিল। দীর্ঘ শুনানি, যুক্তিতর্ক শেষে ৮ ডিসেম্বর রায় দেওয়া হলো। রায়ে ২০ আসামির ফাঁসি এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। রায়ে আবরারের বাবা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: