ফেইসবুকে 'ভুয়া আইডি খুলে' সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়িয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দির ভাঙচুরসহ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার ঘটনার প্রায় সাড়ে ৬ বছর পর এক মামলার রায় ঘোষণা করেছে আদালত। এতে ১৩ জন আসামিকে চার বছরের কারাদণ্ডের আদেশ জারি করা করা হয়।
আজ বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) দুপুর একটায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ পারভেজ কারাদণ্ডাদেশের পাশাপাশি প্রত্যেককে দুই হাজার টাকা করে জরিমানা করেন। দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা এই ঘটনায় করা আটটি মামলার মধ্যে এটি প্রথম রায়।
কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হলেন-মোখলেছ মিয়া, মো. মফিজুল হক, খসরু মিয়া, নাজির রহমান, মো. মাহফুজ মিয়া, ইদু মিয়া, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পদাক ও সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মো. আব্দুল আহাদ, সায়হাম রাব্বি শ্যাম, মীর কাশেম, আনিছ মিয়া, তাবারক রেজা, সচিব চৌধুরী, হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি। রায় দেয়ার সময় আটজন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন মোখলেছ মিয়া, খসরু মিয়া, নাজির রহমান, মো. মাহফুজ মিয়া, ইদু মিয়া, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শেখ মো. আব্দুল আহাদ, মীর কাশেম, সচিব চৌধুরী। পলাকত আসামিরা হলেন- মফিজুল হক, সায়েম রাব্বি শ্যাম,আনিস মিয়া, তাবারক রেজা ও আতিকুর রহমান আঁখি।
উল্লেখ্য, ফেসবুকে রসরাজ দাস নামে এক তরুণের আইডি থেকে ধর্ম অবমাননাকর ছবি পোস্টের জেরে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদরে হিন্দুদের ১৫টি মন্দির ও অর্ধশতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়। এসব ঘটনায় নাসিরনগর থানায় আটটি মামলা হয় সে সময়।
৩ নভেম্বর দিনগত রাত সাড়ে চারটার দিকে দুর্বৃত্তরা উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়ার গোবর্ধন রায়ের (৫১) বাড়ির সামনের পুরাতন দুর্গা মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে। এতে মন্দিরের অধিকাংশ আগুনে পুড়ে যায়। একই সময় উপজেলার ঠাকুরপাড়ার কেশব চক্রবর্তীর বাড়ির রান্নাঘরেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে নাসিরনগর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) সাধন কান্তি চৌধুরী সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থরা কেউ মামলা দিতে রাজি না হওয়ায় ওই বছরের ৬ নভেম্বর এসআই সাধন কান্ত চৌধুরী অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় গ্রেপ্তার আটজন আসামি দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে রয়েছেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর তদন্ত করে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ১৩জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী সরকারি কৌশলী মোস্তাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আজকের শুনানিতে ১১জন সাক্ষী দিয়েছেন। সাক্ষীদের সাক্ষ্য অনুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত ১৩ জনকে সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। এই রায়ের মাধ্যমে হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘর পোড়ানোর ঘটনায় ন্যায় বিচার হয়েছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউক ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারমান কামরুজ্জামান মামুন বলেন, কোনো সাক্ষী মামলায় অভিযুক্ত হওয়া কাউকে ঘটনাস্থলে দেখতে পাননি। বাদী নিজেও ঘটনাস্থলে কোনো আসামিকে দেখেনি। আমরা বার বার আদালতকে বলেছি, সাজা প্রদান করতে হলে নূন্যতম সাক্ষী প্রয়োজন। আমরা ন্যায় বিচার পায়নি। অনতিবিলম্বে উচ্চ আদালতে আপিল করব।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রে আদালতের পরিদর্শক কাজী দিদারুল আলম বলেন, রায় প্রদানের সময় এজলাসে ৮জন আসামি উপস্থিত ছিলেন। এই মামলায় পুলিশ তাদেরকে আরও আগেই গ্রেপ্তার করে। আটজন আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
রসরাজের ফেসবুকের পোস্টের জেরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উপজেলা শাখার নেতারা নাসিরনগর কলেজ মোড়ে বিক্ষোভের ডাক দেন। অন্যদিকে খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নেতারা নাসিরনগর খেলার মাঠে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেন। পৃথক এই সমাবেশ চলাকালে উপজেলা সদরে ১৫টি মন্দির ও হিন্দুসম্প্রদায়ের শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় সাতটি মামলা হয়। আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে পোস্ট দেয়ার অভিযোগ এনে রসরাজের নামে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ধারায় একটি মামলা করে পুলিশ। আট মামলায় প্রায় তিন হাজার লোককে আসামি করা হয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: