বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। পঙক্তিটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর(বিবিএস) উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের অনুপাত ১০২:১০০। এতে দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী। এই বিপুল সংখ্যক নারীকে বাদ দিয়ে কোন দেশ বা জাতির উন্নয়ন এর চাকা কখনও সচল থাকতে পারে না। বিবিএস এর ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে শ্রমবাজারে নারীর অংশ গ্রহণ ছিলো ৩৬ শতাংশ। তবে ২০১৩ সালের জরিপে তা নেমে এসেছিলো ৩৩.৫ শতাংশে। তবে কেন শ্রমবাজারে নারীর অংশ গ্রহণ কমছে তা নিয়ে কোন গবেষণা হয়নি। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বিপুল সংখ্যক নারী হয়ে উঠছেন অনলাইন উদ্যোক্তা। বর্তমান বাজার ব্যাবস্থায় অনলাইন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম। যেখানে নারীরা উল্লেখযোগ্য হারে এগিয়ে আছে। অথচ এই নারীদেরই কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির স্বীকার হতে হচ্ছে।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কর্মজীবী নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে সহায়তা করার চেয়ে দমিয়ে রাখতে বেশি আগ্রহী। ফলে ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে সমাজে নিজের অবস্থান সৃষ্টি করতে হচ্ছে কর্মজীবী নারীদের। এ প্রসঙ্গে সোনিয়া রহমান (কর্মজীবী) বলেন, "ভোর হলো দোর খোল খুকুমণি উঠরে.... খুকুমণিদের যেমন ঘুম থেকে ডাকতে হয় তেমনি ডাকার জন্য খুকুমণির মাকে আরও আগে ঘুম থেকে উঠতে হয়। তারপর রান্নাঘর, পরিবারের সবার পছন্দমতো নাস্তা তৈরি, তাদের সারাদিন এর খাবার গুছিয়ে রাখা, বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়া, নিজের কর্মস্থলের জন্য তৈরি হওয়া, তারপর সারাদিনের কর্মব্যাস্ততা, মিটিং, এরই মধ্যে খবর নিতে হয় সন্তান ও পরিবারের সবার। রাতে বাসায় ফিরে আবার সবার পছন্দমতো খাবার তৈরি করা, সন্তানদের পড়তে বসানো।" সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালনের দায়িত্বটা যেন অবধারিতভাবে মায়ের। যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিরতি থাকলেও এই সংসার সামলানোর যুদ্ধে বিরতি বলে কিছু নেই।
একজন কর্মজীবী নারীকে প্রতিনিয়ত লড়ে যেতে হয়। দিনের পর দিন নারী ঘরে বাইরে এত যে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন পরিবারে বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এর কতটুকু মর্যাদা পাচ্ছেন? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না বস্তুত কর্মজীবী নারীরাই অফিস ও পরিবার এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখেন। কোন কোন পুরুষ তাঁর অর্ধাঙ্গীকে সাহায্য করে থাকেন। তবে বেশিরভাগ পুরুষই সাহায্য করেন না। আবার কোন কোন পুরুষ সাহায্য করতে চাইলেও তাঁর পরিবারের সদস্যরা এটা নিয়ে হাসি তামাশা করেন। এমনকি কোন কোন নারীকে শশুড়বাড়ি থেকে শর্ত দেওয়া হয় যে স্বামী-সন্তান-সংসার সব সামলে যদি চাকরি করতে পারো তবেই শুধু চাকরি করতে অনুমতি দেওয়া হবে। বিবিএস এর এক জরিপে দেখা যায় কর্মজীবী পুরুষ এর তুলনায় কর্মজীবী নারী কাজ করেন ৩ গুণ।
ঘরের সব ঝক্কি -ঝামেলা সামলে একজন নারী যখন কর্মক্ষেত্রে যেতে বের হন তখন বেশিরভাগ নারীই গণ পরিবহন ব্যাবহার করেন। আমাদের দেশে গণপরিবহনে একজন নারীকে বাসের ড্রাইভার হেল্পার থেকে শুরু করে পুরুষ সহযাত্রী দ্বারা যৌন হয়রানিসহ নানান হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। দেশে গণপরিবহন মোটেই নারীবান্ধব নয়। গণপরিবহনে নারী যে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। সরকার কিছু কিছু রুটে শুধু নারীদের জন্য পরিবহনের ব্যাবস্থা করেছেন তবে তা একেবারেই অপ্রতুল। গণপরিবহনে ৯৪% নারী হয়রানির শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে; সেটা কৃষি কাজ করা নারী বা গার্মেন্টস শিল্পের নরী শ্রমিক থেকে শুরু করে উচ্চ পদস্থ সরকারি /বেসরকারি চাকুরি করা কর্মজীবী নারীদের তাঁদের আশেপাশের পুরুষ সহকর্মী বা যার অধীনস্ত হয়ে কাজ করতে হচ্ছে তার দ্বারা যৌন হয়রানিসহ নানান হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ সম্পর্কে বেশিরভাগ নারীই মুখ খোলেন না এবং কোন আইনানুগ ব্যাবস্থা নিতে চান না চাকরি ও মানসম্মান হারানোর ভয়ে।
এ প্রসঙ্গে জান্নাতুল মুবাশ্বিরা বলেন, "আমি এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দেওয়ার পর সেখানকার এমডি আমাকে নির্বাচিত করেন এবং সেদিনই সন্ধ্যার পর ডিনার করতে বলেন। আমি ইগনোর করি। তারপর আমি মাত্র ৫ দিন টিকতে পেরেছিলাম। সেই এমডি আমাকে এই পাঁচ দিনে অনবরত মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া সহ বিদেশে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে যাচ্ছিলো। তারপর তার ইশারা ইঙ্গিত অসহনীয় পর্যায় গেলে আমি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হই"।
নাজনিন জাহান জানান, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের এমডি তার প্রায় সকল নারী কর্মীর সাথে অশোভন অশ্লীল ভাষায় যা ইচ্ছে তাই বলেন। বেশিরভাগ নতুন নারী কর্মীকে মোটা অঙ্কের টাকা এবং নানাবিধ সুবিধা প্রদানের প্রলোভন দেখান এবং তাকে ব্যাক্তিগত সময় দিতে হবে বলে পেছনে লেগে থাকেন। এভাবে অনেক নারীই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। অনেকে আবার আমার মতো এমন অসহনীয় পরিস্থিতিতে টিকে থাকেন এবং চাকরী হারানোর ভয়ে মুখ খোলেন না।
ফিজা ইসলাম এর মতে, কর্মক্ষেত্রে অনেক পুরুষ সহকর্মীরা নারীদের দলের অংশ মনে করেন না। অথচ সেই পুরুষ সহকর্মীদের আড্ডার বিষয়বস্তু এমন থাকে যা নারীদের জন্য বিব্রতকর। জিনিয়া রহমান জানান,আমাদের প্রতিষ্ঠানে একবার নারীদের মাসিককালীন ছুটির প্রসঙ্গ উঠলে এক পুরুষ সহকর্মী বলে উঠেন, "এরপর থেকে নারীদের নিয়োগ দেওয়ার আগে দুইবার ভাবা উচিত"। অপেক্ষাকৃত উর্ধতন পেশায় নিযুক্ত নারীদের কর্মস্থল অনেকটা শোভন ও শালীন হলেও গার্মেন্টস বা কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত নারী শ্রমিকদের জীবন কি পরিমাণ দূর্বিষহ সমস্যায় অতিবাহিত হয় তা বলে শেষ করা যায় না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয় না। যে কয়দিন এর ছুটি দেওয়া হয় সে কয়দিন এর বেতন কাটা হয়।এছাড়াও নারী কর্মীদের বেতনও বৈষম্য করা হয়। কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। ২০০৯ সালে হাইকোর্ট কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধে যে নির্দেশনা দেয় তাতে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। অভিযোগ দেওয়ার ব্যাবস্থা এবং তার নিষ্পত্তির ব্যাবস্থার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তা অনুসরণ করছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭% প্রতিষ্ঠান ওই কমিটির ব্যাপারেই জানেন না। নাসিমুল মিনু মনে করেন,আমাদের আইনগুলো নারীবান্ধব করতে হবে আর মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। বাংলাদেশ উন্নয়ন এর গতি ধারায় সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ের বিভিন্ন সূচকে জনসংখ্যার অর্ধাংশ নারীরাও সমানতালে ভূমিকা রেখে চলছে। শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত দূর্বল এবং সামাজিক রক্ষণশীলতার জালে আবদ্ধ নারীদের হরেক রকম বিপত্তি আর বিভ্রান্তির শিকার হতে হয় কর্মজীবনের উপস্থিত পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে পেশাগত জীবনে সিংহভাগ নারীই অবহেলা, অবিচার আর অপমানের আবর্তে পড়েন। সামাজিক বিধি নিষেধের কঠোর বেড়াজাল আজ অবধি নারীর চলার পথ নিরাপদ, নির্বিঘ্ন আর মুক্ত করতে পারেনি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: