দেশে করোনা টিকার চাহিদা মেটাতে সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে স্পুটনিক-ভি টিকা কিনতে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হলেও এখনো দুদেশের মধ্যে কোনো চুক্তি সম্পন্ন হয়নি।তবে একটি প্রস্তাবিত চুক্তিপত্র পাঠিয়েছে রাশিয়া।
এ প্রস্তাবে প্রায় ৩০টি বিষয়ে সংশোধন আনতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। সেখানে ১০নং সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয়, ‘প্রতি ডোজ টিকার দাম ৯ দশমিক ৯৫ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অত্যধিক বলে প্রতীয়মান হয়। তাই টিকার দামের জন্য দরকষাকষি করা আবশ্যক।’
সরকারের এ সংশোধনী প্রস্তাবের সঙ্গে একমত দেশের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, টিকার মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি কূটনৈতিক তৎপরতা ও রাশিয়ায় পর্যাপ্ত উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে।
তবে এ তৎপরতার পাশাপাশি টিকা উৎপাদনকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোও জরুরি। কারণ একবার টিকা দিয়েই করোনা নির্মূল করা সম্ভব হবে না।
সম্প্রতি করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ সংক্রান্ত সাত সদস্যের আন্তঃমন্ত্রণালয় পরামর্শক কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যসেবা সচিবের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ৫ মে। সেখানে স্পুটনিক-ভি টিকা কিনতে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে সম্ভাব্য পর্যবেক্ষণ সমন্বিত করে দ্রুত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে এবং বিক্রেতার সঙ্গে দরকষাকষি ও চুক্তি চূড়ান্ত করতে বলা হয়েছে।
পাশাপাশি দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে ধাপে ধাপে টিকা পরিকল্পনার আওতায় আনার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। এজন্য দ্রুত তিন কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নিতে বলা হয়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রতি ডোজ ৯ দশমিক ৯৫ ডলার রাশিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। তাদের এ প্রস্তাবের বিপরীতে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু সংশোধনী পাঠানো হয়েছে। যেখানে দাম কমানোর জন্য দরকষাকষি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত দুই ডোজের দাম মডার্না বা ফাইজারের এক ডোজের চেয়ে কম।
তিনি আরও বলেন, চায়নার যে টিকা নিয়ে আলোচনা চলছে সেটার দামের কোনো প্রস্তাব আমরা এখনো পাইনি। আমরা আশা করি দ্রুতই টিকা পাব। সেজন্য রাত-দিন চেষ্টা করছি। কিন্তু চাহিদার তুলনায় টিকার সংকট রয়েছে। তারপরও আমরা অ্যাস্ট্রাজেনেকার জন্য বেশি চেষ্টা করছি। যেখানে উৎপাদন হচ্ছে বা মজুত রয়েছে সেখান থেকে আনার চেষ্টা করছি।
রাশিয়ার প্রস্তাবিত ‘সাপ্লাই অ্যাগ্রিমেন্ট’র ওপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে ৩০টি সংশোধনী আনার কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে টিকার মূল্য ছাড়া আরও আছে-দুটি ডোজের মধ্যবর্তী সময়ে (১ অথবা ২ মাস) নির্দিষ্ট থাকায় বিক্রেতা যদি ওই সময়ের মধ্যে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রথম ডোজ গ্রহণকারীর কোনো উপকার হওয়ার সুযোগ থাকে না। তাই এ দায়িত্ব বিক্রেতাকেই বহন করতে হবে। এক্ষেত্রে চুক্তিতে প্রথম ডোজ সরবরাহের পর দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের নির্ধারিত সময়ের আগেই সেটি সরবরাহের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত।
মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত চুক্তির খসড়ায় প্রথম চালান সরবরাহের আগেই মোট চুক্তির ৫০ শতাংশ দাম পরিশোধের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতি চালানে যে পরিমাণ টিকা সরবরাহ করা হবে তার দাম অগ্রিম হিসাবে ‘নোটিশ অব রেডিনেস’ প্রাপ্তির ৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রেরণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত চুক্তির খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, আমদানি করা টিকা কত তাপমাত্রায় ও আর্দ্রতায় পরিবহণ করতে হবে এবং সংরক্ষণ করতে হবে তার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। কাজেই উল্লিখিত বিষয়ে বাংলাদেশের সক্ষমতা আছে কিনা এ বিষয়ে ধারণা পাওয়ার জন্য সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা আবশ্যক বলে মতামত দেওয়া হয়েছে।
মূল প্রস্তাবে প্রতি ডোজের জন্য শূন্য দশমিক এক শতাংশ হারে রয়ালিটি প্রদানের বিষয়ে উল্লেখ আছে। এ রয়েলিটি দামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে ‘ডেফিনেশন অ্যান্ড ইন্টারপ্রিটেশন’র আওতায় মূল্যের প্রকৃত সংজ্ঞা প্রদান করতে বলা হয়েছে। স্পুটনিক কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান যদি সরল বিশ্বাসে বা নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কিছু করে থাকে তাহলে তা থেকে অব্যাহতি পাবে। এক্ষেত্রে সংশোধনী আনতে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
খসড়ার ১৩.১ ধারায় উল্লেখ করে সংশোধনীর ২৫ নম্বরে বলা হয়েছে, ‘চুক্তির কোনো শর্ত লঙ্ঘন বা প্রকাশের জন্য ক্রেতা বিক্রেতাকে ১০ লাখ মার্কিন ডলার অথবা ওই শর্ত প্রকাশের জন্য মোট ক্ষতি-এ দুটির মধ্যে যেটি বেশি সেই পরিমাণ অর্থ বিক্রেতাকে দিতে হবে। কিন্তু ক্রেতার ক্ষেত্রে অনুরূপ লঙ্ঘনের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
ন্যায্যতার স্বার্থে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন বা প্রকাশের জন্য দায়ী পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক।’ পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ বাবদ এক লাখ মার্কিন ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত চুক্তিপত্রের ৬.৪ ধারা উল্লেখ করে সংশোধনীর ১৭ নম্বরে বলা হয়েছে, কোনো চালানের পণ্যের গুণগত মান ঠিক না থাকলেও মূল্য পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। যা পুরোপরি বিক্রেতার পক্ষে যায়।
এ শর্তের পরিবর্তে প্রস্তাব করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব বিক্রেতার ওপর বর্তায়। এছাড়া চুক্তিপত্রে উভয়পক্ষকে ট্যাক্স পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে যে পক্ষ আয় করবে সেই পক্ষ অথবা প্রত্যেক পক্ষ নিজ নিজ দেশে ট্যাক্স-ভ্যাট পরিশোধ করবে-এ মর্মে শর্ত সংযুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: