করোনার ভৌতিক কালো ছায়া পিছ নিয়েছে প্রায় একবছরের বেশি সময় নিয়ে। গেল বছর মার্চ মাস থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ বিরাজ করছে ভয়ংকর এক নীরবতা। শিক্ষার্থী বা অভিভাবক সকলের জিজ্ঞাসা একটাই "সব কবে ঠিক হবে"! কিন্তু সময়টা আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে আগামীর শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে? করোনার কারণে তৈরি হওয়া অনলাইন আর অফলাইনের শিক্ষার যে বৈষম্য আমরা দেখেছি তা কি সমাধান করতে পারবো? সমাধান করতে গেলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষায় উদ্ভাবনীয় ব্যক্তিদের ভূমিকা অথবা শিক্ষায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের ভূমিকাই বা কী হবে? তা নিয়ে আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশনের আলোকিত টিচার্স আয়োজন করেছিল ‘কোভিড-১৯ এবং এর পরবর্তী শিক্ষা পুনঃপরিকল্পনা’ শিরোনামে তিনটি প্যানেল ডিসকাশন।
আমরা কীভাবে আগামীর বিশ্বে একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য পরিবেশন করতে পারি, মহামারী চলাকালীন এবং পরবর্তী মহামারীগুলোর জন্য প্রচেষ্টার সম্মিলিত বুদ্ধি গঠনের কিভাবে একটি সুযোগ হবে, শিক্ষায় কতটুকু সংস্করণ করা প্রয়োজন অথবা সংস্করণ করতে হলে কোন কোন বিষয়গুলো আমাদের ভেবে দেখা দরকার তা আলোচনায় উঠে আসে। শিক্ষা পুনঃসংস্ককরণে শিক্ষা কাঠামো, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রমসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা বিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় আর যা বের হয়ে এসেছে, সেই বিষয়গুলো বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
কারিকুলাম পুনঃসংস্করণ: শিক্ষার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ এ শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনা মহামারীর পর আগামী কারিকুলাম গতানুগতিক হবে না। বর্তমান সময় ও আগামীর কথা মাথায় রেখেই কারিকুলাম পুনঃসংস্করণ করা জরুরি। তারা মনে করেন, বর্তমানে প্রয়োজন কমিউনিটি বেইজড বা ক্রাউড সোর্স কারিকুলাম। যার মাধ্যমে শিক্ষা যতটুকু কমিউনিটির প্রয়োজন, ততটুকু কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কমিউনিটি বেইজড কারিকুলামের ফলে শিক্ষা বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব। কারিকুলাম প্রস্তুতিতে অবশ্যই শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয় করতে হবে। জরুরি অবস্থায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভূমিকা কী হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। জীবনমুখী ও প্রাকৃতিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে অনেক। দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলামের পাশাপাশি বাস্তবমুখী নানা কার্যক্রমও কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
এডুকেশনাল রিসোর্স: প্যানেল ডিসকাশনে আলোচকরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের শিখনের জন্য যুগোপযোগী এডুকেশনাল রিসোর্স প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইগুলো আরও যুগোপযোগী এবং বিস্তৃত করে তৈরি করতে হবে। প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের সাথে একটা করে ওয়ার্কবুক তৈরি করে দিলে শিক্ষার্থীরা বাসায় বসে বাড়ির কাজগুলো নিজেরাই সম্পূর্ণ করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের পড়া মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আনতে হবে পরিবর্তন। প্রয়োজনে সামাজিক মাধ্যম যেমন- হোয়াটসআপ, ইমো, ভাইভার, ফেসবুক, ইউটিউব এবং জুম ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য ইন্টারনেট, কম্পিউটার, রেডিও, টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোনের ব্যবহার আরও সহজলভ্য করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষা প্রদানের জন্য ফিচার ফোন এবং বাইটস সাইজ এডুকেশন চালু করার কথা উঠে এসেছে।
একুশ শতকের দক্ষতা: সময়ের সাথে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের দক্ষতায় দক্ষ করে তুলতে হবে। ২১ শতকের দক্ষতাগুলো যেমন- জটিল চিন্তা ও সমস্যা সমাধান, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সহযোগিতামূলক ও দলগত দক্ষতা, নৈতিকতা ও সহমর্মিতা, সক্রিয়তা নিয়ে আরও ভাবতে হবে। বর্তমানে এ দক্ষতাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।আগামীর সম্ভাবনাগুলো নিরূপন করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে দক্ষতাগুলোকে কার্যকরী করে তুলতে হবে। এই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জটিল চিন্তা করা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। শিক্ষার্থীরা এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আগামীর সময়কে খুব সহজে মোকাবেলা করতে পারবে।
মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা: বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে আরও সুদৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার জন্য মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেকোন জরুরি সময়ে যেকোন সমস্যা সবার সহযোগিতা নিয়ে কিভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব এবং মানসিক শক্তি আরও সুদৃঢ় করার উপায়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও মানসিকভাবে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষমতা রাখতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমেও একে অপরের পাশে এসে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার উপায়গুলোও আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।
প্রথায় আবদ্ধ শিক্ষা না-কি সিলেবাসের বাইরে পরিকল্পনা: শিক্ষার্থীরা যেন প্রাকৃতিকভাবে শিখতে পারে সেই চেষ্টা করতে হবে। হোম স্কুলিংয়ের মাধ্যমে বাসায় বসে কীভাবে হাতেকলমে কিংবা খেলাধুলার মাধ্যমে শিখতে পারে, সেই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করতে হবে। সিলেবাসে আবদ্ধ না রেখে শিক্ষার্থীর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। শিক্ষার পদ্ধতিগুলো- হোক সমস্যা ভিত্তিক, প্রজেক্ট ভিত্তিক, ধারণা বা অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিখন।
শিক্ষা বাজেট: আমাদের দেশে জিডিপির মাত্র ২.২% বরাদ্দ করা হয় শিক্ষায়, যা অপ্রতুল। বর্তমানের শিক্ষার এই বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে বাজেট আরও বাড়াতে হবে। সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন নতুন স্টার্ট-আপ গড়ে তুলতে হবে। স্টার্ট-আপ উদ্যোক্তাদের জন্য দিতে হবে নানান প্রণোদনা, যেন তারা রিসোর্স ও কনটেন্টের মান ও সংখ্যা আরও বাড়াতে পারেন। সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে তৈরি করতে হবে এডুকেশন-ফান্ডিং। বাজেট তৈরির আগে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিতে হবে।
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ: এ সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়। সরকারের রয়েছে পরিকল্পনা ও শিক্ষানীতি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে কাজের বাস্তবিক অভিজ্ঞতা এবং প্রচুর রিসোর্স। আগামীকে মোকাবেলা করার জন্য যৌথভাবে কাজ করতে হবে। পাবলিক- প্রাইভেট পার্টনারশিপগুলোর সুযোগ ও সমন্বয়ের উদ্যোগ রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
চাকরির বাজার: সময়ের সাথে সাথে চাকরির বাজার পরিবর্তন হচ্ছে। আগামীর বাজার আরও দ্রুত পরিবর্তন হবে।
বর্তমান সমস্যাকে মোকাবেলা করে আগামী সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন নতুন নতুন রিসোর্স ও কনটেন্ট তৈরি করা- এই রিসোর্স ও কনটেন্ট তৈরির জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল প্রয়োজন হবে। ফলে আগামীতে চাকরির বাজারে নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
প্যারেন্টিং এডুকেশন: আগামীতে হয়তো বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রমের সময়সীমা কমে যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা বাসায়ই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করবে। নতুনভাবে তৈরি হবে ‘হোম স্কুলিং আইডিয়া’। হোম স্কুলিংয়ের জন্য প্যারেন্টিং এডুকেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিভাবক একজন ভালো শিক্ষক কিভাবে হয়ে উঠতে পারেন তার উপর গুরুত্ব বাড়বে। ফলে একজন অভিভাবকের দায়িত্বও বেড়ে যাবে। সন্তান লালন- পালনের পাশাপাশি সন্তানের সুশিক্ষা অর্জনের জন্য বিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্ক আরও বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীর পড়া তৈরিতে সহযোগিতা, বাসায় বসে মূল্যায়ন ও ফিডব্যাক দেওয়ার জন্য প্যারেন্টিং এডুকেশনের প্রয়োজন হবে। তাই প্যারেন্টিং এডুকেশনের উপর আমাদের গুরুত্ব খুব তাড়াতাড়ি বাড়াতে হবে।
বিদ্যালয়ের ভূমিকা: সময়ের সাথে সাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভূমিকাও পরিবর্তন হচ্ছে। শুধু জ্ঞান বিতরণই নয়, জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ কমিউনিটিতে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। জিপিএ ভিত্তিক শিক্ষার্থী তৈরি না করে মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষার্থী তৈরি করতে হবে। বিদ্যালয়গুলোকে সমাজের যেকোন জরুরি-পরিষেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শিক্ষক হলো শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করার প্রাণ। সময়ের সাথে সাথে শিক্ষকদের কাজের পরিধি অনেক বেড়েছে। বেড়েছে অনেক চ্যালেঞ্জও। বর্তমান সমস্যা মোকাবেলা করে আগামীর সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ, আধুনিক ও সময়োপযোগী শিক্ষক তৈরি করতে হবে। ডিজিটাল রিসোর্স তৈরি করার জন্য এবং এডুকেশন টুলস ব্যবহার করার জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। তাই শিক্ষক প্রশিক্ষণের সব ব্যবস্থা নিতে হবে। গতানুগতিক চিন্তা থেকে বের করে বিশ্বায়নের সব সুযোগ যেন আমাদের শিক্ষকরা গ্রহণ করতে পারে, তার জন্য নানা কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। প্রশিক্ষিত শিক্ষক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা সমাজের সম্পদ।
যেকোন মহামারী রাষ্ট্রকে যেমন সমস্যায় ফেলে দেয়; তেমন সমস্যা উত্তোরণের জন্য অনেক সুযোগও তৈরি করে দেয়। শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনঃসংস্করণ করার মাধ্যমে বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধান করে সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে হবে। সে জন্য সবার সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা খুবই জরুরি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: