করোনাকালে অনলাইনে ৩১ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন পুষ্টিবিদ মুরাদ

শাহরিয়ার নাসের, নোবিপ্রবি প্রতিনিধি | ১৮ জুন ২০২১, ০৭:২৭

আম প্যাকেজিং এ ব্যস্ত মুরাদ

পুষ্টিবিদ মুরাদ পারভেজ। রাজশাহীর পবা থানার পাইকপাড়া গ্রামের মুন্তাজ আলী এবং রেণুফা বেগম দম্পতির তৃতীয় সন্তান। নওহাটা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে মাধ্যমিক এবং নওহাটা ডিগ্রি কলেজ থেকে একই বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি)। শৈশব ও কৈশোরে দারিদ্র্যতা কি জিনিস তা উপলব্ধি করেছেন হাড়েহাড়ে। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে দারিদ্র্যতাকে জয় করে বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এখন এগিয়ে চলছেন তিনি। একাই প্রতিষ্ঠা করেছেন অনলাইন আমের হাট 'ম্যাঙ্গো লাভার' এবং বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন মাটির তৈজসপত্রের প্রতিষ্ঠান 'পোড়ামাটি'।

গরুর দুধ বিক্রি করে পড়াশোনার খরচ জোগাতেন মা। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় মুরাদ পারভেজের ফেলে আসা দিনগুলো ছিলো সংগ্রামমুখর। অতীতের কষ্টের কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অজপাড়াগাঁয়ের সন্তান মুরাদ পারভেজ বলছিলেন, 'আমার জন্ম দরিদ্র কৃষক পরিবারে। যতটুকু মনে পড়ে একদম ছোটবেলায়ও বাবার সঙ্গে মাঠে কৃষি কাজ করতে যেতাম। দুইবেলা নিয়ম করে ছাগল নিয়ে মাঠে যেতাম, গরুর জন্য ঘাস কাটতাম। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনার পাশাপাশি এগুলো ছিল আমার নিত্যদিনের কাজ। মা গরুর দুধ বিক্রি করে পড়ালেখার খরচ যোগাতেন। বাবার দুটো সংসার ছিল তাই বাবার পক্ষে সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতো না। পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে নবম শ্রেণিতে ওঠার আগে কখনো প্রাইভেট পড়ার সুযোগও আমার হয়নি।'

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে যেদিন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ঠিক সেদিনই প্রকাশ হয় মুরাদের স্নাতকের ফলাফল। এরপর দেশজুড়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমেই বাড়তে থাকে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আসে লকডাউনের ঘোষণা। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে গেলেও বসে থাকেননি স্নাতক শেষ করা মুরাদ। পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করায় তিনি স্বপ্ন দেখতে লাগলেন নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করার। সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ওই বছরের জুন মাসে এসে। বাগানের শতভাগ কেমিক্যালমুক্ত আম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুলভ মূল্যে সরবরাহ করা এবং সবাইকে অনলাইনে কেনাকাটার প্রতি আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে জুন মাসেই তিনি পুরোদমে কাজ শুরু করেন রাজশাহীর আম নিয়ে। প্রথম বছরেই অনলাইনে ৬ হাজার কেজি আম বিক্রি করেন তিনি। অন্য আম ব্যবসায়ীদের মতো ক্রেতাদের থেকে অগ্রিম টাকা নেননি মুরাদ। আম হাতে পেয়েই ক্রেতারা তাকে টাকা দিতো। কোনো কারণে আম খারাপ হলে আবার নতুন করে আম পাঠাতেন তিনি। প্রথম বছরের আম বিক্রি হতে লাভের টাকা খরচ না করে মুরাদ দুটি গরু ক্রয় করেন। পাশাপাশি শুরু করেন মাটির তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবসা। অনলাইনে নয়মাসে সারাদেশে প্রায় ৬৩০টি পানির জার বিক্রি করেন তিনি। ক্রেতাদের বিশ্বস্ততা অর্জন করে এরপর আবার চলতি বছরে এসে মাত্র ১৮ দিনে ১৭ টন আম বিক্রি করেছেন তিনি।

করোনাকালীন সময়ে অনলাইনে মোট ৩১ লাখ টাকার আম ও মাটির তৈজসপত্র বিক্রি করেছেন পুষ্টিবিদ মুরাদ। এখনও পুরোদমে চলছে তার ব্যবসা। আম ব্যবসায়ের মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তিনি ১৩ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন। গাছ থেকে আম সংগ্রহ, পরিবহণ ও প্যাকেজিংয়ের কাজে নিযুক্ত করেছেন ওই শ্রমিকদের। এ ছাড়া কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৪৩ জন শিক্ষার্থী তার থেকে পণ্য কিনে পুনরায় বিক্রি করে উপার্জন করছেন। তাদের পাইকারি মূল্যেই পণ্য দেন তিনি।

দারিদ্র্যতার কারণে নবম শ্রেণির আগে প্রাইভেট পড়তে না পারা মুরাদ এখন সফল ব্যবসায়ী। তার মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও পরিশ্রমের ফল ভোগ করছে পরিবারও। পরিবারকেও পূর্ণ সাপোর্ট দিচ্ছেন তিনি। মুরাদ গর্ব করে বলেন, 'অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে আমি আমার পরিবারে অবদান রাখছি এটাই আমার বড় পাওয়া। পরিবারের সাপোর্টও সবসময় ছিল। আমার বাবা অত্যন্ত মেধাবী হওয়া স্বত্বেও অভাবের কারণে মেট্রিক পরীক্ষা দিতে পারেননি। দারিদ্র্যতার মধ্যেও বাবা চেয়েছেন আমি বড় হই। আমার ব্যবসায়েও সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন তিনি।'

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে গ্রামে গিয়ে অনলাইনে আম এবং মাটির তৈজসপত্র বিক্রি করার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি মুরাদের এলাকার কিছু মানুষ। মুরাদের সমালোচনায় মত্ত ছিলেন তারা। তবে আগে তারা সমালোচনা করলেও এখন সাফল্য দেখে প্রশংসা করেন। এমনকি নায্য দাম পেতে মুরাদের কাছে তাদের আম বাগানের আম বাগান বিক্রির জন্যও ঘুরেন তারা। মুরাদের কাছে আম বাগান বিক্রি করে সঠিক দাম পেয়ে চাষিরাও সন্তুষ্ট।

চাকরি নয় ব্যবসার সঙ্গেই যুক্ত থাকতে হতে চান পুষ্টিবিদ মুরাদ। অনলাইন প্লাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে হতে চান বড় উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, 'চাকরি করার ইচ্ছে নেই আমার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সরকারি জব কিংবা বড় কোনো কোম্পানিতে চাকরি করতে হবে বিষয়টা এমন না। বিজনেস করেও, উদ্যোক্তা হয়েও সুন্দরভাবে পরিবারকে সাপোর্ট দেয়া যায়, নিজের বেকারত্ব দূর করা যায়। আমি স্বপ্ন দেখি বড় উদ্যোক্তা হওয়ার। এখন তো বাজারে ভেজাল খাদ্যের সয়লাব। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করতে চাই আমি। অনলাইন প্লাটফর্মে মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন করারও ইচ্ছে আমার। এখন অনলাইনের প্রতি একটা নেগেটিভ ধারণা জন্মে গেছে। সেই ধারণা পাল্টাতেই আমি আগে প্রোডাক্ট দেই পরে টাকা নেই। '



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: