মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন বন্দর উন্নয়নের কাজ করছে ভারতীয় কনগ্লোমারেট আদানি গ্রুপ। বর্মি সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার ইকোনমিক কোঅপারেশনের (এমইসি) সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে এসেছে। সেক্ষেত্রে কয়েক কোটি ডলারের এ বিনিয়োগ আদানি গ্রুপকে বিপাকে ফেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। কারণ এমইসির ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন আদানি গ্রুপকে ওয়াশিংটনের রোষানলে ফেলে দেয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিবেশ। সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে রাস্তায় নামা বিক্ষোভকারীদের নৃশংসভাবে দমনের অভিযোগ উঠছে নেপিদোর ওপর। এ অভিযোগে তাতমাদো (বর্মি সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এতে বিপাকে পড়েছে দেশটিতে বিনিয়োগকারী বিদেশী কোম্পানিগুলো। বর্মি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ বা ব্যবসায় নামা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে এ বিপত্তি আরো বেশি।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ইয়াঙ্গুন রিজিয়ন ইনভেস্টমেন্ট কমিশনের ফাঁস হওয়া একটি নথির বরাদ দিয়ে এতে দাবি করা হয়, সেখানকার একটি বন্দরের ভূমি ইজারা বাবদ এমইসিকে কয়েক কোটি ডলার পরিশোধ করছে আদানি গ্রুপ। এক্ষেত্রে প্রদেয় অর্থের সম্ভাব্য পরিমাণ ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার পর্যন্ত। এর মধ্যে ভূমি ইজারা বাবদ দেয়া হতে পারে ৩ কোটি ডলার।
এছাড়া বন্দরটির উন্নয়নকাজের অনুমোদন প্রক্রিয়া নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এ অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের যোগসূত্র রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও শিল্পপতি গৌতম আদানির মালিকানাধীন আদানি গ্রুপ দাবি করছে, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের ভিত্তিতেই বন্দরটির কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য বর্মি সামরিক নেতাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি।
যদিও বিভিন্ন ভিডিও ও আলোকচিত্রের বরাত দিয়ে অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমটি দাবি করছে, আদানি পোর্টসের প্রধান নির্বাহী করণ আদানি ২০১৯ সালের জুলাইয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। মিন অং হ্লাইংসহ তাতমাদোর কয়েকজন জেনারেলের বিরুদ্ধে ওই সময়ই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এ পদক্ষেপ নিয়েছিল ওয়াশিংটন।
প্রসঙ্গত, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বেই গত ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তাতমাদো। এর প্রতিবাদে দেশটির জনগণ রাস্তায় নেমে এলে কঠোর দমন-পীড়ন চালায় বর্মি নিরাপত্তা বাহিনী। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মারা যায় বেসামরিক কয়েকশ মানুষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে এমইসি ও মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের (এমইএইচপিসিএল) ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ।
সেনা নিয়ন্ত্রিত হোল্ডিং কোম্পানি হিসেবে মিয়ানমারের অর্থনীতিতে অগ্রাধিকারমূলক বেশকিছু সুবিধা ভোগ করে প্রতিষ্ঠান দুটি। এ দুই প্রতিষ্ঠানসহ এগুলোর সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলোকে মূলত মিন অং হ্লাইং এবং তাতমাদোর বর্তমান ও সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন।
অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমটিতে প্রকাশিত এ নথি ফাঁস করেছে অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস ও জাস্টিস ফর মিয়ানমার নামে দুটি মানবাধিকার সংস্থা। নথিটির তথ্য অনুযায়ী, ইজারার বাইরেও ভূমি ক্লিয়ারেন্স ফি বাবদ এমইসিকে আরো ২ কোটি ২০ লাখ ডলার পরিশোধ করতে পারে আদানি গ্রুপ।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে মিয়ানমারের সামরিক কনগ্লোমারেটগুলোর সঙ্গে ব্যবসা চালানো প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকায় আদানি পোর্টসেরও নাম ছিল। ওই প্রতিবেদনে তাতমাদোর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে তাদের সঙ্গে ব্যবসা না চালানোর অনুরোধ জানানো হয়।
এদিকে তাতমাদোর সঙ্গে ব্যবসার অভিযোগে আদানি গ্রুপকে নিয়ে কথা উঠেছে অস্ট্রেলিয়ায়ও। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগে ২০১৯ সালে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠন করেছিল জাতিসংঘ। ওই মিশনের সদস্য ছিলেন অস্ট্রেলীয় আইনজীবী ক্রিস সিডোটি। অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, অস্ট্রেলিয়া ও অস্ট্রেলিয়াবাসীর জন্য প্রশ্ন হলো, আমরা কি এমন কোনো কোম্পানিকে স্বাগত জানাব কিনা, যা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীসংশ্লিষ্টদের সম্পদ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
অস্ট্রেলিয়ায় আদানি পোর্টসের চলমান একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্পের প্রতি ইঙ্গিত করে এ বক্তব্য রেখেছেন ক্রিস সিডোটি। ওই প্রকল্পের আওতায় কুইন্সল্যান্ডে অ্যাবোট পয়েন্ট কোল টার্মিনাল নির্মাণ করছে আদানি পোর্টস।
সিডোটি বলেন, আদানি পোর্টসে বিনিয়োগকারীদের প্রতি প্রশ্ন হলো, তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কার্যক্রমের তহবিল জোগান দিতে চান কিনা। কারণ আদানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা পরোক্ষভাবে তা-ই করছেন।
প্রসঙ্গত, আদানি পোর্টসে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ফিউচার ফান্ডের বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ৩২ কোটি ডলার। মার্কিন বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কারণে এ বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়েও এক ধরনের গুঞ্জন তুলেছে অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যম। তবে তহবিলটির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, এ বিনিয়োগ চুক্তি প্রত্যাহারের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: