বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধে এখন বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের প্রায় দ্বিগুণ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। উদ্যোক্তারা বিদেশি উৎসের ঋণ পরিশোধে দুই ক্ষেত্রেই বেশি অর্থ পরিশোধে বাধ্য হচ্ছেন। ডলার সংকটের কারণে টাকার মান প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গেছে। এজন্য ঋণের মূলধন ও সুদ দুই ক্ষেত্রেই ২৫ শতাংশ বেশি দিতে হচ্ছে। এজন্য ঋণ পরিশোধে লাগছে বেশি অর্থ।
যদি কোনো কোম্পানি ১০০ ডলার ঋণ নিয়ে থাকে তবে তারা বাংলাদেশি ব্যাংক থেকে পেয়েছে ৮ হাজার ৫০০ টাকা। এখন গ্রাহককে একই ঋণের মূলধন পরিশোধ করতে হচ্ছে ১১ হাজার টাকা। সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রেও একইভাবে অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৫৩ শতাংশ বেড়ে ২৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আগের বছর একই সময় যা ছিল ১৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী গ্রাহকদের অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হবে ৬২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। তবে গ্রেস পিরিয়ড ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিশোধ সুবিধা থাকলে পরে কমতেও পারে। ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের ২০২১-২২ অর্থবছরে কস্ট অব ফান্ড ছিল ৪৭৩ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় চারগুণ বেশি। একবছর আগে ছিল ১২৪ কোটি টাকা। এই সময় প্রতিষ্ঠানটিকে কস্ট অব ফান্ড অতিরিক্ত প্রায় ৩০৪ কোটি টাকার লোকসান দিতে হয়েছে টাকার মান কমে যাওয়ায়। বিশেষ করে ডলার ও ইউরোর দর বৃদ্ধির জন্য।
প্রতিষ্ঠানটি যখন বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয় তখন ডলারের দর ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা যার বর্তমানে আন্তব্যাংক লেনদেন হার ৯৬ টাকা। বাস্তবে দিতে হয় প্রায় ৯৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, যদি টাকার মান না কমতো তাহলে ওয়ালটন ৩০৪ কোটি টাকা মুনাফা বেশি করত। এই সংকট এখনো চলমান; ফলত পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। তারা বলছেন, আমাদের বিদেশি ঋণ আছে। এজন্য সুদ পরিশোধ করতে হবে। টাকার মান কমে যাওয়ায় সুদ হার অনেক বেশি পড়ছে। এটা শুধু অপারশেনাল কস্ট হিসেবে নয় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রেও অনেক বেশি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি, সুদ হার বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক অস্থিরতা পুরো অর্থনীতিকে আঘাত করছে। বাংলাদেশ আন্তব্যাংক ডলার লেনদেন হার নির্ধারণ হয়েছে ৯৬ টাকা যা আগের বছরের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। এখন আমদানিকারকদের বিল পরিশোধে ১০৫ টাকায় ডলার কিনতে হয়। ব্যাংকে ডলার বিক্রি করতে হয় ৯৩ থেকে ৯৫ টাকায়। এলসি বিলের জন্য ডলার কিনতে হয় ১১০ টাকায়। মূলধনী পণ্যের দর বাড়তি পড়ছে স্থানীয় মুদ্রার দাম কমে যাওয়ায়। ফলে পণ্য উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হচ্ছে। অতিরিক্ত দামের কারণে এই পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। কারণ ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে।
একটি স্টিল কোম্পানির কর্মকর্তা জানান, আগের বছর টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছিল। আমরা প্রভিশন রেখে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি। কিন্তু এখন প্রভিশন রেখে কিছুতেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এখন আমাদের বিদেশি ঋণের জন্য অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতেই হচ্ছে। তবে এটা ঠিক স্থানীয় ঋণের চেয়ে বিদেশি ঋণ অনেক বেশি আকর্ষণীয়। এখন একটি পথ খোলা আছে পণ্যের দাম বাড়ানো। তবে সেটা এক প্রকার অসম্ভব। কারণ ক্রেতারা সেই বর্ধিত দামে কিনতে পারবেন না।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ার প্রভাব সম্পর্কে আগেই অবহিত ছিলাম। এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে গ্রাহকরা জানত। তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ ঋণ গ্রহীতা টাকায় ঋণ নেন। এটা তাদের বড় ধরনের লোকসান থেকে বাঁচিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে। দেশীয় উদ্যোক্তারা মূলত তিন কারণে বিদেশি ঋণ নেন। এক, কম সুদ, দুই, দীর্ঘ মেয়াদী ও বৃহৎ অঙ্ক ঋণদানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের অক্ষমতা।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: