আটটি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা সংস্কৃতি তুলে ধরতে উৎসব

আনোয়ার হোসেন আকাশ, রাণীশংকৈল(ঠাকুরগাঁও) | ৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০৮

ছবিঃ সংগৃহীত

খোলা আকাশের নিচে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খড়ের ছাউনি। ছাউনির বেড়ার মাটির প্রলেপে নানা কারুকাজ। সামনে সাজানো তির-ধনুক, ঢোল-মাদল, কাপড়চোপড়, অলংকার, থালাবাসন, খাবারদাবারসহ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য নানা উপকরণ। নানা বয়সের মানুষ আসছে আর তা ঘুরে ঘুরে উপভোগ করছে।

আজ শুক্রবার ঠাকুরগাঁওয়ের আকচা গ্রামের লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘর চত্বরে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। সেখানে আয়োজন করা হয়েছিল ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উৎসব। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) আয়োজনে উৎসবে ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলায় বসবাস করা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজন অংশ নেন। উৎসবে সাঁওতাল, ওঁরাও, পাহান, মাহালি, মুশহর, কড়া, তুরি ও ভুনজার সম্প্রদায়ের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, অলংকার, হাতিয়ার, তৈজসপত্র ও ঐতিহ্য-সংবলিত জিনিসপত্র ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। উৎসবের উদ্বোধন করেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবেল হেমব্রম। ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক মুহম্মদ শহীদ উজ জামানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন গিলাবাড়ী গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য সরলা মুর্মু। পরে দিনাজপুর-১ আসনের সাংসদ মনোরঞ্জন শীল, সাবেক সাংসদ সেলিনা জাহান, দাতা সংস্থা হেকস-ইপারের বাংলাদেশের প্রধান ডোরা চৌধুরী বক্তব্য দেন। উৎসবে আটটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা নাচ ও গানের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ‘সমতলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি: বিবর্তনের ধারা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম। বক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ইস্রাফিল শাহীন, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আবদুর রশিদ।

বেলা আড়াইটায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক আয়োজনের শুরুতে সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী শিকার ও বিয়ের নাচগান উপস্থিত শত দর্শককে মুগ্ধ করে। পাহান সম্প্রদায়ের কামরাম উৎসব, ওঁরাও সম্প্রদায়ের যুদ্ধজয়ের নাচ যেন প্রকৃতির সঙ্গে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনসংগ্রামের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এ অনুষ্ঠানে আটটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তাদের জীবন-জীবিকা নাচ ও গানের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলে। পাশাপাশি চলে স্টল পরিদর্শন।

উৎসবে পরিবার নিয়ে এসেছিলেন কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা শারমিন আক্তার। স্টল ঘুরে দেখার সময় বললেন, ‘দেশে অনেক সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। তাদের জীবন-জীবিকা, খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতির মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। এই উৎসবে না এলে আমরা তা জানতেই পারতাম না।’

স্টল নিয়ে আসা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সদস্য ভেরোনিকা এক্কা বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি হরিয়ে যেতে বসেছে। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমাদের সংস্কৃতিগুলো মানুষের সামনে তুলো ধরার সুযোগ পেয়েছি।’

বিকেল চারটায় সমাপনী অধিবেশনে উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল মনসুর। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, অ্যাম্বাসি অব সুইজারল্যান্ডের ডেপুটি হেড অব কো-অপারেশন কোরিন এইচ পিয়ানি প্রমুখ বক্তব্য দেন। পরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য বিশুরাম মুর্মু, গোপাল মুর্মু, দাওদ সরেনকে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক সংগঠকের সম্মাননা দেওয়া হয়। আর রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলামকে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক বন্ধু হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হয়।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: