আশুগঞ্জে মধ্যযুগীয় কায়দায় কিশোরকে নির্যাতন

গোলাম সারোয়ার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি | ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, ১৭:৪৫

আশুগঞ্জে মধ্যযুগীয় কায়দায় কিশোরকে নির্যাতন

চাঁদার জন্য ব্রাহ্মণবড়িয়ার আশুগঞ্জের চরচারতলায় দিদার হোসেন নামে ১৪ বছরের এক কিশোরকে এক পা গাছে ঝুলিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় মারধর করেছে জামির, তোফাজ্জল, মাসুদ, শাকিল, আকাশ ও নাসির নামে মাদকব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজরা। এসময় তারা কিশোরের পরিবারকে ২ লাখ টাকা চাঁদা দেয়ার জন্য মোবাইলে কল করলে শেষ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকায় মেলে মুক্তি।

এনিয়ে কাউকে জানালে দিদারকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়ার পাশাপাশি তার দুই বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ারও হুমকি দেয় তারা। মাদকব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজদের ভয়ে দিদারের পরিবারের কেউ মুখ না খুললেও দিদারকে মারধরের একটি ভিডিও সাংবাদিকদের কাছে আসে। নিরাপত্তার ভয়ে পরিবারের লোকজন এখন আতঙ্কিত। পরে সাংবাদিকরা দিদারের পরিবারের কাছে গেলে তারা সব খুলে বলে। এই নির্যাতনের সুষ্টু বিচার চায় দিদারের পরিবার।

সরেজমিনে দিদারের পরিবার ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, দিদারের বাবা খায়ের মিয়া পেশায় একজন জেলে। মেঘনা থেকে মাছ ধরে কোনোরকমে তাদের সংসার চলে। সংসার চালাতে পড়াশুনা বাদ দিয়ে সেও বাবার সাথে মেঘনা থেকে মাছ ধরে।

মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে একই এলাকার চরচারতলা গ্রামের ল্যাংটার ব্রয়লারের সামনে তোফাজ্জলের কাছে নৌকার কাজের পাওনা টাকা চাইতে গেলে দিদারের সাথে তোফাজ্জলের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে দুপুরে দিদার বাড়ি থেকে রাস্তায় বের হলে একই এলাকার কুদ্দুস মিয়ার ছেলে জামির (৪০), ইসলাম মিয়ার ছেলে তোফাজ্জল (২৮), ইউনুছ মিয়ার ছেলে মাসুদ (৩৮), শাহজাহান মিয়ার ছেলে শাকিল (৩০), হামদু মিয়ার ছেলে আকাশ (৩০) ও হারুন মিয়ার ছেলে নাসির (৪০) দিদারকে ধরে নিয়ে যায়। পরে দিদারকে মিডল্যান্ড পাওয়ার প্লান্টের পাশে নিউ এশিয়া প্রজেক্টের খালি জায়গায় নিয়ে যায়। এরপর সেখানে একটি কড়ই গাছের ডালে দিদারকে ডান পায়ে দড়ি বেধে ঝুলিয়ে জামিরসহ সকলেই মিলে মোটা রশি দিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে।

এরপর দিদারের মাকে মাসুদের মোবাইল দিয়ে কল করে তার ছেলেকে ২ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে বলা হয়। এসময় দিদারকে মা আশপাশের প্রতিবেশি নিয়ে দৌড়ে ছেলেকে উদ্ধার করতে যায়। পরে সেখানে গিয়ে সে তার ছেলেকে গাছ থেকে নামিয়ে আনার জন্য সবার পায়ে ধরে অনুরোধ করে। টাকা না দিলে দিদারকে নামানো হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় তারা। পরে দিদারের মা টাকা দিতে রাজি হলে দিদারকে গাছ থেকে নামিয়ে আনা হয়। দিদারের মা বাসায় এসে আশপাশের লোকের কাছ থেকে ধার করে ৩০ হাজার টাকা জামির ও তোফাজ্জলের কাছে দেয়। পরে জামির, তোফাজ্জল,মাসুদ, শাকিল, আকাশ ও নাসিরসহ সবাই এই বিষয়ে কাউকে না জানানোর জন্য হুমকি দিয়ে যায়। যদি কাউকে জানানো হয় তাহলে দিদারকে মেরে ফেলা হবে এবং দিদারের দুই বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয় তারা।

এই বিষয়ে দিদার হোসেন বলেন, তোফাজ্জলের কাছে নৌকার কাজের পাওনা টাকা চাইতে গেলে তোফাজ্জলের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে দুপুরে বাড়ি থেকে রাস্তায় বের হলে জামির, তোফাজ্জল, মাসুদ, শাকিল, আকাশ ও নাসির আমাকে কোন কথা ছাড়াই ধরে নিয়ে যায়। নিউ এশিয়া প্রজেক্টের খালি যায়গায় নিয়ে সেখানে একটি কড়ই গাছের ডালে ডান পায়ে দড়ি বেধে ঝুলিয়ে জামিরসহ সকলেই মিলে মোটা রশি দিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে।

দিদারের মা রহিমা খাতুন বলেন, এলাকাবাসী দিদারকে মারতে দেখে আমাকে খবর দেয়। এসময় মাসুদের মোবাইল দিয়ে কল করে দিদারকে ছাড়াতে ২ লাখ টাকা নিয়ে নিউ এশিয়া প্রজেক্টে যেতে বলে। না হলে ছেলেকে মেরে ফেলবে। পরে আমি গিয়ে দেখি আমার ছেলেকে গাছে ঝুলিয়ে মারধর করছে তারা। আমি তাদের হাতে পায়ে ধরে আমার ছেলেকে নিচে নামিয়ে আনি। এসময় মাসুদসহ সবাই আমার কাছে দুই লাখ টাকা দিতে বলে। পরে আমি সবার কাছে থেকে ধার দেনা করে করে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে আমার ছেলেকে তাদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসি। বাকি টাকা আমি পরে দিব বলে আসি। আমি এর বিচার চাই।

দিদারের বাবা খায়ের মিয়া বলেন, কোন কারণ ছাড়াই অন্যায়ভাবে আমার ছেলেকে জামির, তোফাজ্জল, মাসুদ, শাকিল, আকাশ ও নাসির গাছের সাথে এক পা ঝুলিয়ে বর্বরভাবে মারধর করে। আমি এই ঘটনার বিচার চাই।

এই বিষয়ে অভিযুক্ত মাসুদ বলেন, দিদার তোফাজ্জলকে একা পেয়ে মারধর করেছে। তাই তোফাজ্জলের বাবা আমাদেরকে বিচার দিয়েছিল। তাই জামির তাকে একটু শাসন করেছে। এটা আবার দিদারের বাবাকেও জানানো হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ এটা শতভাগ অন্যায় করা হয়েছে বলে স্বীকার করেছে।

আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাহিদ আহাম্মেদ বলেন, আমাদেরকে এই বিষয়ে কেউ জানায়নি। আমরা সাংবাদিকদের কাছ থেকে বিষয়টি জেনেছি। ইতোমধ্যে ঘটনার বিস্তারিত জানার জন্য পুলিশ পাঠানো হয়েছে। পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে অভিযোগ পেলে পরবর্তি আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: