৭ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করাকালীন সময়ে মেরি আক্তারকে বিয়ে দেয় পরিবার। কয়েক বছর পর মারা যায় স্বামী। কোলে তখন ২ ছেলে। বড় ছেলের বয়স তিন বছর, ছোট ছেলের বয়স ৯ মাস। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই সন্তানের মুখে দিকে চেয়ে আর দ্বিতীয়বার বিয়েতে বসেননি তিনি।
শ্বশুড়বাড়ীতে স্বামীর রেখে যাওয়া দেড় বিঘা জমি আবাদ এবং স্থানীয় বেসরকারি ক্লিনিকগুলোকে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে খন্ডকালীন কাজ করে দুই সন্তানকে লালন-পালন করেছেন তিনি। গত ১১ ফেব্রুয়ারি বড় ছেলে মিলন রনি খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। এ আনন্দে আত্মহারা এখন তিনি।
মেরির গল্পটা চার লাইনে সহজ ভাবে বলা গেলেও বাস্তবতটা ভয়ঙ্কর। সমাজের নানান জনের নানা প্রশ্ন, কটুকথা শুনে ১৬ বছর পাড়ি দিতে হয়েছে মেরি আক্তারকে। তবে এখন শ্বশুড়বাড়ীসহ পুরো উপজেলায় সফল মা হিসেবে প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।
মেরি আক্তারের বাড়ী ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়পলাশবাড়ী ইউনিয়নের পারুয়া গ্রামে। তিনি ওই এলাকার মৃত মটর শ্রমিক আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী।
সদ্য খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চান্স পাওয়া মিলন রনিকে বালিয়াডাঙ্গী পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করিয়েছেন তিনি। এরপরে ঢাকাতেই ছেলেকে কোচিং করিয়েছেন মেডিকেল ভর্তির জন্য। আর ছোট ছেলেকে মাধ্যমিক পাশের পর ঠাকুরগাঁও শহরের ইকো পাঠশালায় উচ্চ মাধ্যমিক পড়ছেন।
খুলনা মেডিকেলে চান্স পাওয়া মিলন রনি বলেন, ৩ বছর বয়সে বাবার কোলে উঠার সোভাগ্য হলেও কোন স্মৃতি মনে নেই তাঁর। এমনকি বাবার মুখের ছবিও তার মনে নেই। বড় হওয়ার পর মা সব চাহিদা পুরণ করেছেন। বুঝতেই দেয়নি যে, তারা দুজনে পিতাহার সন্তান।
'মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ জিপিএ ৫ পাওয়ার পাশ করার পর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন মিলন। এরপরে ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়া অবস্থায় মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের চলাফেরা ও কার্যক্রম তাকে আরও অনুপ্রাণিত করে। চিকিৎসক হয়ে মায়ের দেখাশোনা এবং এলাকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চান মিলন।'।
মিলনের মা মেরি আক্তার জানান, দুই ছেলে কি হবে, এটা তাদের সিদ্ধান্ত। আমার কোন মতামত নেই। স্বামী মারা যাওয়ার পর যুদ্ধ করে ছেলে দুটোকে পড়াশোনা করাচ্ছি। বড় ছেলের মেডিকেলে চান্স পাওয়ার খবর শোনার পর সব কষ্ট ভুলে গেছি। ছেলে দুটো মানুষের মত মানুষ হবে। এটাই আশা, প্রত্যাশা।
মিলনের নানী মরজিনা খাতুন বলেন, ছোট বেলা থেকেই মিলন আমাদের বাড়ীতে মানুষ হয়েছে। তার মা কৃষি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে আমাদের বাড়ী থেকেই তার খালা প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা করতো। তার মেডিকেলে ভর্তি সুযোগে আমরা আনন্দিত। স্বামী হারা মেয়েটার কষ্ট সফল হয়েছে।
প্রতিবেশীরা জানান, মিলনের মা অত্যন্ত পরিশ্রমি। মাঠে কাজ শেষ করে ক্লিনিকে ডিউটি, সন্তানের পড়াশোনা দেখা। সবই করেছে একাই। আমাদের সমাজে অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার পর স্বামীর অনুপস্থিতি এমন সাহসী মেয়ে খুব দেখা যায়। তাকে দেখে প্রতিবেশীরা অনুপ্রাণিত।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফছানা কাওছার বলেন, সমাজের চারপাশে থাকা মানুষগুলো মেরি কে দেখে অনুপ্রাণিত হবে। যে কোন সহযোগিতা মিলন রনির পাশে থাকবে উপজেলা প্রশাসন।
ঠাকুরগাঁও ২ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মাজহারুল ইসলাম সুজন বলেন, মেরি আক্তার একজন সফল জননী। তার ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে কোন সহযোগিতা লাগলে আমরা তাদের পাশে থাকবো।
এই বিভাগের অন্যান্য খবর
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: