সংবাদ প্রকাশের জন্য বক্তব্য নিতে গিয়ে হুমকির শিকার সাংবাদিক “রবিউল”

নিজস্ব প্রতিবেদক | ২৬ জানুয়ারী ২০২৪, ১৩:২৭

সংবাদ প্রকাশের জন্য বক্তব্য নিতে গিয়ে হুমকির শিকার সাংবাদিক “রবিউল”

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যবর্ধনে লাগানো হয়েছিল গাছ ও বাগান। আর সেখানেই অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে শতাধিক দোকান। আর এসব দোকান থেকে একটি সংগঠনের নাম দিয়ে তোলা হয় চাঁদা। আর এসব নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জন্য বক্তব্য নিতে অভিযুক্ত মো. মাসুদ করিমকে ফোন করা হলে সাংবাদিককে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে ভয়িভীতি দেখান তিনি। 


বুধবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে নগরের খুলশী থানায় হুমকির বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন ভুক্তভোগী ওই সাংবাদিক। 

অভিযুক্ত মাসুদ করিম পতেঙ্গা থানার দক্ষিণ পতেঙ্গা ফুলছড়ি পাড়া এলাকার বশর বলির বাড়ির নূর মোহাম্মদের পুত্র। 


হুমকির শিকার ওই সাংবাদিকের নাম মোহাম্মদ রবিউল হোসেন। তিনি চট্টগ্রামভিত্তিক নিউজপোর্টাল সিভয়েস-২৪ এর স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত।


সাধারণ ডায়েরিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, তিনি তার অফিসে বসে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে অভিযুক্ত মো. মাসুদ করিমকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে সরকারী জায়গা দখল করে দোকান নিমার্ণ করে প্রশাসনে নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে প্রশ্ন করলে কথোপকথনের এক পর্যায়ে উকিল নোটিশ প্রদান এবং মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোসহ বিভিন্ন প্রকার ভয়-ভীতি প্রদান করে। 


জানা গেছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) নগরের সাগরিকা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর উপকূলে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘চিটাগং সিটি আউটার রিং রোড’ নির্মাণ করেছে। সেই প্রকল্পের আওতায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে সৈকতের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য লাগানো ফুলের গাছ ও বাগান নষ্ট করে তৈরি করা হয়েছে দুই শতাধিক দোকান। প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে ‘পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হকার ক্যামেরাম্যান শ্রমজীবী সমবায় লিমিটেড’ সমিতির ব্যানারে দৈনিক দোকান ভেদে তোলা হয় ১শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। আর এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন ওই সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মাসুদ করিম প্রকাশ কুত্তা মাসুদ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসুদের বিরুদ্ধে পতেঙ্গা থানায় ২০১৫ সালের একটি চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। পতেঙ্গা সৈকত ঘিরে দোকান বাণিজ্যের পাশাপাশি তিনি টানেল রোডে ওই সমিতির ব্যানারে বানিয়েছেন মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড। যেখান থেকে দৈনিক মাইক্রোবাস প্রতি ১শ’ টাকা চাঁদা তোলা হয়। প্রতিদিন সেখানে অন্তত ৫০টি মাইক্রোবাস টানেলে যাত্রী আনা নেওয়া করে।


শুধু এসবই নয়, পতেঙ্গা সৈকতের মূল পয়েন্ট থেকে বালুচরে দিকে নামতে ওয়াকওয়েতে বসানো হয়েছে নৌকা, দোলনাসহ ৮ থেকে ১০টি রাইড। যেখান থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এসবের নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে মাসুদ করিম। 


এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী সাংবাদিক মোহাম্মদ রবিউল বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের অবৈধ দোকানপাট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পর্যটকরা অভিযোগ করে আসছিলেন। সেই ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশের জন্য আমি সমুদ্র সৈকতে গিয়ে বেশ কিছু দোকানদার এবং পর্যটকদের সাথে কথা বলি। এরপর জানতে পারি এসব নিয়ন্ত্রণ করেন মাসুদ করিম। সেই মোতাবেক অফিসে এসে তার বক্তব্য জানতে চেয়ে কল করি। এরপর তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সেসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই আমাকে নানা ধরনের ব্লেইম দিতে থাকেন। 

তিনি বলেন, ‘এরপর তার মানহানি হয়েছে এবং আমি মানসিক টর্চার করছি উল্লেখ করে তিনি আমাকে উকিল নোটিশ পাঠাবেন এবং ভয় যেন সংবাদ প্রকাশ না করি সেজন্য মামলা করবেন বলে হুমকি দেন। কথোপকথনের সময় তিনি একাধিকবার আমার নীতি-নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। যা আমার জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। পুলিশ প্রশাসনও তার এসব চাঁদাবাজির বিষয়ে ওয়াকিবহাল।’


জানতে চাইলে অভিযুক্ত মো. মাসুদ করিম বলেন, হুমকির বিষয়টি মিথ্যা৷ প্রয়োজনে আপনি কল রেকর্ড শোনেন। সে (ভুক্তভোগী সাংবাদিক) আমার প্রতিপক্ষের প্ররোচনায় এসব করছে।’


পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসনের নামে এরকম চাঁদা তোলা হয়। কিন্তু পতেঙ্গা সৈকতের ওখান থেকে থানা পুলিশ কোনো ধরনের টাকা নেয় না। আর আপনি যে সমিতির কথা বলছেন, আমার মনে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তাদের কাগজপত্র যাচাই করা উচিত।’


তিনি বলেন, ‘বীচ নিয়ে আসলে আমরা খুব ঝামেলার মধ্যে আছি। ওখানে মূলত ৩টি সিন্ডিকেট আছে যারা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায় এবং ঝামেলা পাকাতে চায়। এটা নিয়ে আমাদেরও মাথাব্যাথা আছে। আমি এবং ডিসি স্যারসহ এগুলোর বিষয়ে তাদের সাথে আমাদের কথা বলার কথা বৃহস্পতিবার। আর উচ্ছেদের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের সাথেও আমার কথা হয়েছে। প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে কিন্তু তারা এসব করছে। আমি অনেককেই বলেছি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে, আমরা গ্রেপ্তার করব।’ ‘


‘আমি এই থানায় যোগদান করেছি অলমোস্ট তিন মাস। এই তিন মাসে একদিনও সিডিএ’র কাউকে আমি দেখিনি। এই সময়ের মধ্যে সিডিএ বলেন বা সিটি করপোরেশন বলেন এই বীচ নিয়ে কারোরই কোনো মাথাব্যাথা নাই। যে যেমন পারতেছে বিভিন্ন নাম ভাঙিয়ে সেখানে চলতেছে।’


এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বন্দর বিভাগের উপকমিশনার শাকিলা সোলতানা বলেন, ‘যেহেতু আমার সাথে টাকার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। যদি অন্য কারও সাথে থাকে তবে সেটার তথ্যপ্রমাণ যদি আমার পর্যন্ত আসে আমি তাকেও জবাবদিহীর আওতায় নিয়ে আসব। আর মাসুদ যার কথা বলছেন, সেটা ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক পত্রিকাতেই লিখেছে আপনারা দেখেছেন। সে নিজেই স্বঘোষিত। সে বীচের ওখানে চাঁদা নিয়ে সেখানকার লোকজনের জীবিকা নির্বাহে সহযোগিতা করে বা বীচের ময়লা পরিষ্কার করে।’

তিনি বলেন, ‘আসলে ওখানকার কোনো দোকানই বৈধ নয়। সব দোকানই অবৈধ। আমি আসলে তাদেরকে বলতে বলতে বিরক্ত। এরা পুরো বীচ এলাকাটার পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলেছে। ওয়াকওয়েতে হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। দুই পাশেই দোকান করে রেখেছে। আমি এটা নিয়ে খুব বিরক্ত। আমি আলাদাভাবে সিডিএ-করপোরেশনের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে আস্বস্ত করেছেন, সর্বোচ্চ একমাসের মধ্যেই সমস্ত দোকানপাট উচ্ছেদ করা হবে।’

সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট করে দোকান নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী ও আউটার রিং রোডের প্রকল্প পরিচালক কাজী হাসান বিন্ শামস্ বলেন, ‘আমরা আগামী সপ্তাহে সেখানকার অবৈধ দোকানগুলো উচ্ছেদের জন্য একটা কর্মসূচি নিয়েছি। উচ্ছেদ করে পতেঙ্গা সৈকতে প্রথম পর্যায়ে যে ব্যবস্থাপনা ছিল তার চেয়েও ভালোভাবে ঢেলে সাজানো হবে। যেন দর্শনার্থীরা সেখানে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেভাবে অরাজকতা চলছে সেখানে স্থানীয় সিন্ডিকেট মিলে, দোকান বসিয়েছে। ওখানে ট্যুরিস্ট পুলিশও আছে। তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদের বিরুদ্ধে কোনো ছাড় নেই। সেখানে আমরা দুটি আন্তর্জাতিক মানের পাবলিক টয়লেট করার সিদ্ধান্তও নিয়েছি। খুব শীঘ্রই এসব বাস্তবায়ন করা হবে।’



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: