সাইফুল ইসলাম তরফদার, ময়মনসিংহ প্রতিনিধিঃ
বেসরকারী হাসপাতালে অস্ত্রপ্রচারে নবজাতক জন্ম দেয়ার পর ভিতরে মপ রেখে সেলাই করেন চিকিৎসক। প্রায় তিন মাস পর আল্টাসনোগ্রাফি রিপোর্টে জরায়ুতে মপ রেখেই সেলাই করা বিষয়টি জানতে পারে চিকিৎসকরা। পরে অপারেশন করে ইনফেকশন হওয়ায় প্রায় ৭৫ শতাংশ জরায়ু ও ফেলোপিয়ান টিউব (বাচ্চা থাকার থলে) কেটে ফেলে দিতে হয় চিকিৎসককে। মাত্রাতিরিক্ত ইনফেকশন হওয়ায় পায়খানার রাস্তায় বাইপাস করে দেয়া হয়েছে। পরপর অপারেশন করায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন ওই নারী।
ময়মনসিংহ নগরীর চরপাড়া ব্রাহ্মপল্লী ১৩/বি হেলথ কেয়ার প্রাইভেট হাসপাতালে এই ঘটনা ঘটে। ওই অস্ত্রপ্রচার (সিজার) করে গাইনি চিকিৎসক ডা. রুপা আক্তার।
ভিক্তিম নারী হাসিনা (৩৫) জেলার ত্রিশাল উপজেলার আউটিয়াল গ্রামের আনিসুরের রহমানের স্ত্রী। আনিসুর রহমান পেশায় রিকশা চালক। আনিসুর রহমান দুই মেয়ে ও সর্বশেষ ছেলে সন্তানসহ তিন জনের বাবা।
বুধবার (১৮ অক্টোরব) বিষয়টি জানাজানি হয়। জানাজানির পর হেলথ কেয়ার প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডা. রুপার সাথে যোগাযোগ করলে একে অপরের উপর দোষ চাপাতে ব্যস্ত।
ভিক্টিম নারীর স্বামী আনিসুর রহমান বলেন, গত ১৭ জুন বিকালে আমার স্ত্রীর প্রসব ব্যথা অনুভব করতে পারেন। পরে তাড়াহুড়া করে ওই দিন সন্ধ্যায় নগরীর চরপাড়া ব্রাহ্মপল্লী ১৩/বি হেলথ কেয়ার প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করি। ভর্তির পর ওই দিন রাত সাড়ে ৯ টার দিকে ওই ক্লিনিকে ডা. রুপা আমার স্ত্রীর সিজার করেন। সিজারে আমার স্ত্রী ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়।
সিজারের পর ছেরে ও মা দু'জনই সুস্থ ছিল। এই ঘটনার তিন দিন পর ২০ জুন ক্লিনিক থেকে রোগীকে ছাড়পত্র দিলে আমরা বাড়িতে চলে যাই। এরপর ক্লিনিকে ড্রেসিং করানো হয়। পরে স্থানীয় চিকিৎসক দিয়ে ড্রেসিং করানো হয়। কিন্তু, ক্ষত জায়গা কোনভাবেই ভাল হচ্ছিল।
এমতাবস্থায় স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে আবার ড্রেসিং করালে ক্ষতস্থলে একটি সুতা পাওয়া যায়। সেলাইয়ের সুতা হবে ভেবে ওই সুতা কেটে ফেলি। কিন্তু আমার স্ত্রী কোন ভাবেই ভাল হচ্ছিল না। হাসিনা শুধু বলতেন তার পেটে ব্যথা করে। এমতাবস্থায় আমার স্ত্রীকে গত ২১ জুলাই কমিনিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হানপাতালে ভর্তি করি৷ কিন্তু সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে ১৪ দিন পর সেখান থেকে আমার স্ত্রীকে ছাড়পত্র দিলে বাড়িতে নিয়ে নিয়ে আসি।
এরপর গত ১৪ আগস্ট ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখানে ভর্তি হলে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে বলেন। পরে ৪ সেপ্টেম্বর ওই হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকরা জানায় আমার স্ত্রীর জরায়ুতে গজের মত কিছু একটা রয়েছে। যে কারণে ভিতরে ইনফেকশন হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন করাতে হবে। পরে ১৩ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে অপারেশন করা হয়। অপারেশন করার পর চিকিৎসকরা কেটে ফেলা জরায়ু, ফেলোপিয়ান টিউব ও পচা রক্তাক্ত কাপর তুলা মেশানো একটি বস্তু দেখায়। যে বস্তুটির কারণে ইনফেকশন হয়েছে এবং জরায়ু ও ফেলোপিয়ান টিউব কেটে ফেলতে হয়েছে। চিকিৎসকরা আরও বলেছে আমার স্ত্রী আর কোন দিন বাচ্চা নিতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, ওই অপারেশন করার পর আমার স্ত্রীকে আরও দুইবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। ৪ দিন থাকার পর গতকাল ১৭ অক্টোবর আবারও হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
বাড়িতে নেয়ার পর হঠাৎ করে পড়ে গিয়ে আর কোন কথাবার্তা বলতে পারছে না। আমি দরিদ্র রিকশা চালক। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে আমি নিঃস্ব। স্ত্রীকে আবার হাসপাতালে আনার মত আমার সামর্থ নাই।
সিজার করা চিকিৎসক রোপা আক্তার বলেন, এবিষয়ে আমার স্বামী আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন।
ডা. রুপা আক্তারের স্বামী আরাফাত বলেন, এমন ভুল অনেক হয়। তবে, আমরা রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয ব্যবস্থা নেব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, ওই নারী ক্লিনিকে সিজার করার পর জরায়ুতে মপ (রক্ত পরিস্কার জন্য তুলা ও কাপর দিয়ে তৈরী বস্তু) রেখেই সেলাই করেন। মপটি প্রায় তিন মাসের বেশি সময় জরায়ুতে থাকায় ইনফেকশন হয়ে যায়। এতে ওই নারী জরায়ু ৭৫ শতাংশ ও ফেলোপিয়ান টিউব কেটে ফেলতে হয়েছে। এছাড়াও পায়খানার রাস্তায় বাইপাস করা হয়েছে।
তবে, গর্ভবতী মায়েদের জন্য আমাদের পরামর্শ থাকবে সাধারণ ক্লিনিকে না গিয়ে সরকারী কোন হাসপাতালে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে সিজার করানো ভাল। তাছাড়া সিজার না করিয়ে নরমাল ডেলিভারী হলে আরও ভাল।
এবিষয়ে হেলপ কেয়ার প্রাইভেট হাসপাতালের ম্যানেজার রুহুল আমিন বলেন, রোগী আমার হাসপাতালে আসছে। আমরা ভর্তি করে বাইরের ডাক্তার দিয়ে সিজার করে দিয়েছি। এখন চিকিৎসক জরায়ুর ভিতরে কি রেখে অপারেশন করেছে। সেটা তো আমাদের দেখার বিষয় না। তারপরেও আমরা রোগীর স্বজনদের খবর দিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু তারা পরে আর কোন যোগাযোগ করেনি। তাছাড়া চিকিৎসকের মামলা করে কেই কিছু করতে পারে না।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, এবিষয়ে কেউ কোন অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এই বিভাগের অন্যান্য খবর
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: