পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হচ্ছে আকাশ-বাতাস। সরকারি-বেসরকারি সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ না থাকায় থামানো যাচ্ছে না এ নীরব মহামারি। পানিতে ডুবে প্রতিটি মৃত্যুই প্রতিরোধযোগ্য বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ।
গ্রামীণ মায়েদের ব্যস্ততা, শহরের কর্মজীবী মানুষের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। এক হাতে সংসারের সব কাজ সামলাতে গিয়ে অনেক সময়ই সন্তানের খেয়াল রাখতে পারেন না মা। আবার গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময়টিতে কখনো কখনো শিশুকে দেখাশোনার জন্য পরিবারের অন্য কাউকে পাওয়াও যায় না। সবার বেখেয়ালে শিশু হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ব্যস্ত রাস্তায় কিংবা পুকুর-জলাশয়ের ধারে। মুহূর্তেই ঘটে যায় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। ফলে সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় সময় পার করতে হয়ে কর্মব্যস্ত অনেক মায়ের। বসতবাড়ির আশপাশে রয়েছে ডোবা, বিল আর পুকুর। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় এসব জলাশয় যেমন অনন্য ভূমিকা রাখছে, তেমনি হয়ে উঠেছে অস্বাভাবিক শিশুমৃত্যুর কারণ। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ফেরে এরকম সন্তান হারানোর গল্প।
গবেষণা বলছে, প্রতিবছর পানিতে ডুবে বাংলাদেশে মৃত্যু ঘটছে প্রায় ১৪ হাজার শিশুর। এ সংখ্যা দিনে গড়ে প্রায় ৪০। ভয়াবহতার এ চিত্র তুলে ধরতে বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে প্রতিদিন বিদ্যালয়ের একটি ক্লাসরুম খালি হয়ে যাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন।
পানিতে ডুবে মৃত্যু সারা বিশ্বে শিশুমৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলেও দেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে নেই তেমন কোনও সচেতনতা। প্রতিদিন-ই কোথাও না কোথাও ঘটছে এ নীরব মৃত্যুর ঘটনা।
সরেজমিনে পটুয়াখালির কলাপাড়া উপজেলার ১০ নম্বর বালিয়াতলীর কোম্পানিপাড়ার ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিনের মত সেদিনও আঁচলে (যেখানে ছোট শিশুদের সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রাখা হয়) গিয়েছিলো শিশুটি। সেখান থেকে ফিরে মায়ের কাছে বায়না করে শাক দিয়ে ভাত খাওয়ার। মা কোহিনূর বেগম দুপুরের রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। চার বছরের ছোট্ট ইয়াসিন নিজেই গোসল করার জন্য বের হয়, ফিরে এসে তার পছন্দের শাক দিয়ে ভাত খাবে মা কে জানিয়ে যায়। এরপর বাবা কামাল ফিদা’র পাশে বসে সিঙ্গাড়া খাওয়া শেষে একাই ছোটে গোসলে। বাবা তখন ব্যস্ত ইয়াসিনের দেড় বছরের ছোট বোনটিকে নিয়ে।
অনেকটা সময় পাড় হবার পরও ইয়াসিন ফিরে না আসার মায়ের মনে সন্দেহ জাগে এবং মা খুঁজতে থাকে। খুঁজার একপর্যায়ে পুকুরঘাটে গিয়ে দেখেন ইয়াসিনের মগ, জুতো সব পুকুরপাড়ে রয়ে গেছে। কিন্তু ইয়াসিন নেই। মায়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে কাঁদায় ডুবে থাকা ইয়াসিনকে তুলে আনেন বাবা। শিশুটির নাক-মুখে তখন কাদার স্তর। পানিতে ডুবে যাওয়াদের প্রাথমিক করণীয় বিষয়ে জ্ঞান না থাকায় শুরু হয় গ্রাম্য চিকিৎসা। পরিস্থিতি অপরিবর্তীত থাকায় কলাপাড়া হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন।
ইয়াসিনদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েকগজ দূরত্বে আরেক শিশু প্রিয়াঙ্কার বাড়ি। ১৫ বছর বয়সী প্রিয়াঙ্কা পানিতে ডুবে মারা যায়। মাত্র ৬ বছর বয়সে প্রবল জ্বরের কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে প্রিয়াঙ্কা। এরপর শরীরের ডানপাশ পুরোপুরি অচল হয়ে যায়। তবে নড়াচড়ায় ভীষণ কষ্ট হলেও মাটিতে বসে হাত-পা টেনে টেনে চলাচল করত শিশুটি।গত বছরের ২২ ডিসেম্বর। অন্যান্য দিনের মত সেদিনও সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার সাথে কথা বলে প্রিয়াঙ্কা। মা সূর্য বানু অসুস্থ থাকায় বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিল না। আর এরই মধ্যে ঘটে যায় পানিতে ডুবে মৃত্যু। ওর নানী পুকুরে থালা-বাসন মাজতে গিয়ে; পাড়ে প্রিয়াঙ্কার জুতা আর পুকুরের মধ্যে ওড়না দেখতে পায়। পরে প্রিয়াঙ্কাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা:
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে সচেতনতার অভাব, দারিদ্রতা ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে।
মৃত্যুর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, প্রতিবছর বন্যায় বাংলাদেশের স্থলভূমির একটি বড় অংশ পানিতে তলিয়ে যায়, ফলে সচেতনতা ও সাঁতারে দক্ষতার অভাব জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। গ্রামীণ এলাকার শিশুরা যারা জলাশয়ের আশপাশে বেড়ে ওঠে তারাও প্রতিদিন পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকে।
এ বিষয়ে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই) এর কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া ম্যানেজার সারওয়ার ই আলম বলেন, “পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনার প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে। এ সময় মা গৃহস্থলির কাজ এবং বাবা রোজগারের তাগিদে বাইরে থাকেন। ভাই-বোন থাকলে তারা স্কুলে বা অন্য কোথাও ব্যস্ত থাকে। এই কয়েক ঘণ্টা সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়ে শিশুটি।”
তিনি বলেন, “সচেতনতার অভাব পানিতে ডুবে মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এমনও কয়েকটি ঘটনা দেখা গিয়েছে, যেখানে বালতি কিংবা পাতিলের পানিতে ডুবেও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বেশিরভাগ দেখা যায় জোড়া মৃত্যুর ঘটনা। সেক্ষেত্রে শিশুটি যখন ডুবে যেতে থাকে তখন তাকে রক্ষা করতে বয়সে তুলনামূলক বড় অপর যে শিশু (তার ভাই-বোন বা আত্মীয়) যায় তাকে সে এমনভাবে আকড়ে ধরে যে দু’জনের কেউ-ই বাঁচতে পারে না।”
প্রতি বছর ডুবছে ১৪ হাজার শিশু:
দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআর’বি- এর গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ১৪ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যুহার কমাতে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকে এসডিজির অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সেখানে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ গুরুত্ব পায়নি। ফলে অসুস্থতাজনিত কারণে শিশু মৃত্যু কমলেও, পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার আগের মতোই আছে।
বাংলাদেশে ২০২২ সালে পানিতে ডুবে ৯ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার বেড়েছে ৮ শতাংশ। এ সময় পানিতে ডুবে মৃতদের মধ্যে ৮১ শতাংশের বয়স ছিল ৯ বছরের কম। আগের বছরের তুলনায় এ হার ৮ শতাংশের বেশি। এসব শিশুদের বেশিরভাগ বাড়ির ২০ কিংবা ৩০ গজের আশেপাশে পুকুর কিংবা ডোবা-জলাশয়ে ডুবে মারা গেছে। সবার আড়ালে জলাশয়ে চলে যায় এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়।
২০২২ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী পানিতে ডুবে ১ হাজার ১৩০টি শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে ২০২০ ও ২০২১ এ দুই বছরে যথাক্রমে ৮০৭ ও ১ হাজার ৩৪৭টি মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’।
প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ ২৮২ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া রংপুর বিভাগে ১৬০, ঢাকা বিভাগে ১৪৯, বরিশালে ১৩১, রাজশাহীতে ১১০, ময়মনসিংহে ১০৪, খুলনা বিভাগে ১০৩ ও সিলেট বিভাগে ৯১ জন মারা যায়।
বেঁচে ফেরা শিশুরা বরণ করছে পঙ্গুত্ব:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর পানিতে ডুবে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। প্রতি ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টি ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যেখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। শহরের চেয়ে গ্রামে এই মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
এছাড়া পানিতে ডুবে মত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া শিশুদের প্রায় ১৩ হাজার স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করে। এদের বেশিরভাগই শ্রবণ প্রতিবন্ধী ও মানসিক ভারসাম্যহীনভাবে বেড়ে উঠছে।
ডুবে যাওয়া রোধে করণীয়:
এই নীরব মৃত্যু রোধে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’-র থেকে জানা যায়, “শিশুর জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের কারও দায়িত্বে রাখা যেতে পারে। এছাড়া পুকুরগুলো অরক্ষিত না রেখে পুকুর বা ডোবার চারপাশে বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অভিভাবকদের তত্ত্বাবধান ছাড়া দলবেঁধে বা একাকী শিশুদের জলাশয়ে গোসল করতে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। পানিতে ডুবে যাওয়ার সময় ও পরে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর করণীয় সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।”
এ নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে, সরকার এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে কাজ করলে ওইসব উন্নয়ন সংস্থা চলে গেলেও কাজ অব্যাহত থাকবে এবং মৃত্যু ঠেকানো যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: