পদ্মার ওপর স্বপ্নের সেতু এখন সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। দৃষ্টি সীমায় পূর্ণ রূপে ভেসে উঠেছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হবে ২৫ জুন।
সেতু চালুর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণ হবে এ অঞ্চলের মানুষের। অর্থনৈতিকভাবে বাগেরহাট অঞ্চলের মানুষ একটু পিছিয়ে পড়লেও পদ্মাসেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে মানুষ আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখছে এ জেলার মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে ,পদ্মা সেতু চালু হলে বাগেরহাটে পর্যটন,কৃষি ও মৎস্যতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। পাল্টে যাবে বাগেরহাটের অর্থনীতি। কর্মসংস্থানের সন্ধানে মোংলা ছেড়ে অনেকে ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকায় বসবাস করলেও পদ্মা সেতু চালু হলেই মানুষ যে যার পূরানো গন্তব্যে ফিরতে শুরু করবে। দেশের শিল্প, পর্যটন,কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হবে বলে কর্মসংস্থানের গতি বাড়ার পাশাপাশি আয়ের বৈষম্যও কমে যাবে।
দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সময় ও দূরত্বকে অন্যতম বাধা মনে করেন। পদ্মা সেতু হলে ওই বাধা অনেকাংশে কেটে যাবে। মোংলা বন্দর থাকায় এ পাশ দিয়ে আমদানি-রপ্তানিও সহজে করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। সব মিলিয়ে একটি বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠার জন্য যে ধরনের পরিবেশ দরকার, তা পাওয়া যাবে এ অঞ্চলে। নতুন নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান,বদলে যাথে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান।
মোংলা বন্দরে গতিশীলতা বাড়বে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন। পায়রা বন্দরের গুরুত্বও বাড়বে। প্রয়োজনীয় আধুনিকায়ন করা হলে পদ্মা সেতুর ব্যবহারে ওই বন্দরও এক বৃহত্তম বন্দরে রূপান্তরিত হবে।
এসব জেলায় গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা। এ সেতু দিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারবে এশিয়ান হাইওয়েতে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান। বিশেষ করে মোংলা বন্দরে পদ্মা সেতুর সুফল এখনই পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী নানা ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। ২০৫ একর জমি নিয়ে এই অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে। এই অঞ্চলে ইপিজেড আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সবই হচ্ছে পদ্মা সেতুকে সামনে রেখে। রেলের কাজও চলছে পুরোদমে। এর সঙ্গে চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ এবং পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হলে দক্ষিণাঞ্চল হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল।
সেতুর উদ্বোধন সামনে রেখে বছর খানেক আগে থেকেই নানা ধরনের কাজ শুরু করছেন বাগেরহাটে কৃষির সঙ্গে জড়িত কৃষক, ব্যবসায়ী ও খামারিরা। পদ্না সেতু চালুতে বাগেরহাট জেলার উদ্যোক্তারা আগে থেকেই বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন যাতে করে সেতু উদ্বোধনের পরপরই এর সুফল পাওয়া যায়। বাগেরহাটে উৎপাদিত বিভিন্ন কাচামাল যা বাইরে নেওয়া ছিল ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। উৎপাদন কারীরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতো। ফলে বাগেরহাট অঞ্চলের কৃষি সেক্টর ছিল অনেকটাই অ-লাভজনক। পদ্মা সেতু চালু হলে যোগাযোগের সংকট কেটে যাওয়ায় কৃষি সেক্টর লাভজনক সেক্টরে রুপ নেবে। এতে অধিমাত্রায় কৃষি উৎপাদনে এ অঞ্চলের মানুষের বেকারত্ব অনেকটা হ্রাস পাবে।
মাছ চাষে বরাবরই সফল বাগেরহাট অঞ্চলের মানুষ। এই মাছ চাষের উপর নির্ভর করে হাজার হাজার মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারছে। কিন্তু যোগাযোগের সমস্যা থাকায় সাধারন মানুষের পক্ষে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করা মোটেও সম্ভব ছিল না। তাদের ধারনা পদ্মা সেতু চালু হলে বাগেহাটের মাছ শিল্পে আরো বড় ধরনের বিপ্লব ঘটবে। সাধারন মানুষ তাদের মাছ ন্যায্য দাবে বিক্রি করতে সক্ষম হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ন ভ্থমিকা রাখবে মৎস্য শিল্প সৃষ্টি হবে প্রচুর কর্মসংস্থান।
বিশ্ব ঐতিহ্যর মধ্যে বাগেরহাটের খানজাহান আলী মাজার,ষাট গম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবন রয়েছে। পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হলে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই মানুষ ঘুরে আসতে পারবে। অনেকের ধারনা পদ্মা সেতু চালুর মাধ্যমে বাগেরহাটে পর্যটন শিল্পের বিপ্লব ঘটবে। দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন ভ্রমন পিপাসুরা পছন্দমত দর্শনীয় স্থান গুলোতে ঘুরে দেখবে। পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে থ্রি স্টার মানের হোটেল-মোটেল ও বিভিন্ন যানবাহন তৈরির চিন্তা করছে ব্যবসায়ীরা। অনেকের ধারনা পদ্মা সেতুর পাশাপাশি খান জাহান আলী (রহঃ) বিমান বন্দর চালু হলে বাগেরহাটে এ শিল্পে আরো অগ্রগতি হবে। এ অঞ্চল সম্ভাবনার ক্ষেত্র মনে করেন অনেক বেকার যুবকরা। পর্যটন শিল্পকে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সঠিক স্থান মনে করেন তারা। এ দিকে পদ্মা সেতু চালু হলে ভ্রমন পিপাসুরা যাতে নির্বিগ্নে স্বাচ্ছন্দে ঘুরতে পারে এবং জেলার দর্শনীয় স্থান আরো আধুনিকায়ন করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক উদ্বোগ গ্রহন করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু চালু হলে যোগাযোগ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধা পাবে বাগেরহাট অঞ্চলের মানুষ। এখন সড়কপথে মোংলা থেকে ঢাকায় যেতে সময় লাগে প্রায় আট থেকে ১২ ঘণ্টা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকলে সময়টা আরও বাড়ে। ঘাটে ২৪ ঘণ্টা আটকে থাকার ঘটনাও রয়েছে। তবে পদ্মা সেতুতে চলাচল শুরু হলে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হবে। তখন সকালে মোংলা থেকে বের হয়ে ঢাকায় গিয়ে কাজ সেরে বিকেলেই ফেরা যাবে মোংলায়। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিনাঞ্চলে পরিবহন ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটবে । এ জন্য পরিবহনের মান বৃদ্ধি করতে কাজ করছেন পরিবহন মালিকরা। পাশাপাশি অনেক তরুনরা পরিবহন সেক্টরকে কাজ করার জন্য উৎসাহিত হচ্ছেন।
বাগেরহাট আন্তঃ জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল বাকী বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিনাঞ্চলে পরিবহন জগতে বিপ্লব ঘটবে। নতুন নতুন গাড়ী যুক্ত হবে এ সকল রুটে। পাশাপাশি শিল্প, কৃষি ও মৎস্য শিল্পের ব্যাপক উন্নযন ঘটবে। সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের।
বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিনাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করবে বাগেরহাট জেলার মানুষ। আমদানি- রপ্তানী বেড়ে যাওয়ায় মোংলা পোর্টের কার্যক্রম আগের চাইতে অনেক বেশি সচল হবে। নতুন নতুন কল-কারখানা সৃষ্টির পাশাপাশি কৃষি, মৎস্য শিল্পে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। অনেক বেকার সমস্যা সমাধান হওয়ায় মোংলার মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধি হবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, মোংলা বন্দরের চাহিদার প্রতিফলন তখনই ঘটবে যখন পদ্মা সেতু চালু হবে। দ্রুত খুলনা- মোংলা রেলওয়ে চালু ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি মোংলা বন্দরের প্রকল্প কার্যক্রম সঠিক ভাবে সম্পন্ন করা হলে মোংলা বন্দরের বিগত বছরের চেয়ে রেকর্ডের সংখ্যা সামনে বাড়তেই থাকবে। পদ্মা সেতু জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভুমিকা রাখবে।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে বাগেরহাট অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। বাগেরহাটে বিশ্ব ঐতিহ্যর খানজাহান মাজার,ষাট গম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবন থাকায় পর্যটক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সৃষ্টির জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন,পদ্মা সেতু চালুর মধ্যে দিয়ে কৃষি ও মৎস্য শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন হবে। কৃষকরা সারা দেশে তাদের পন্য রপ্তানী করতে পারবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে বাগেরহাট জেলার বেকার সমস্য অনেকাংশে কমে যাবে। তিনি আরো বলেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে মোংলা বন্দরের ক্যাপাসিটি আরো বাড়ানো হচ্ছে। মোংলা বন্দরকে ঘিরে এ অঞ্চলের উন্নয়ন আরো তরান্বিত হবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও খানজাহান আলী বিমান বন্দরের কাজ শেষ হলে বাগেরহাট অর্থনীতিতে আরো বড় ভুমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: