ক্রিকেট টুর্নামেন্টেকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধের জেরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক জব্বার হলের মসজিদ প্রাঙ্গণে ও কয়েকটা রুমে ভাঙ্গচুরের ঘটনায় অভিযুক্ত ৪ শিক্ষার্থীকে শোকজ করেছে হল কর্তৃপক্ষ।
রবিবার (৫ ডিসেম্বর) শহীদ রফিক জব্বার হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ স্বাক্ষরিত অফিসে আদেশের মাধ্যমে ওই ৪ শিক্ষার্থীকে শোকজ করা হয়। এতে ঘটনায় অভিযুক্তদের আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে স্বপেক্ষে যুক্তি ও বক্তব্য উপস্থাপন করতে বলা হয়।
অভিযুক্তরা হলেন বাংলা বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী অলক কুমার পাল, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসান আল মাসুদ, ইতিহাস বিভাগের ৪৭ ব্যাচের ছাত্র আকাশ তালুকদার এবং অর্থনীতি বিভাগের ৪৭ ব্যাচের ছাত্র মোস্তফা ফয়সাল রাফি। এরা সবাই শহীদ রফিক জব্বার হল ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী।
এছাড়া ঘটনাটি তদন্ত করতে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির প্রধান হিসেবে আছেন শহীদ রফিক জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক মো. আফাজ উদ্দীন, সহকারী অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য ও হল সূত্রে জানা যায়, গত ২৯ নভেম্বর প্রতিবছরের ন্যায় শহীদ রফিক জব্বার হলে শুরু হয় 'ইয়াকুব-মিশু স্মৃতি শর্টপিচ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট'। হলের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের উদ্যেগে এবারের টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়।
গত বুধবার (১ ডিসেম্বর) পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের টিম বনাম ৪৭ ব্যাচের টিমের কোয়ার্টার ফাইনাল চলাকালীন দুই পক্ষের খেলোয়াড়দের মধ্যে বাকবিতন্ডা শুরু হয়। ৪৭ ব্যাচের খেলোয়াড়েরা খেলা পরিচালনায় আম্পায়ারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে মাঠে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এসময় তারা ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীদেরও দর্শক হিসেবে না থাকার জন্য বকাঝকা করে মাঠ ত্যাগ করায়। এক পর্যায়ে তারা টুর্নামেন্ট বন্ধ করে দেয়ারও হুমকি দেয়। তবে সিনিয়র শিক্ষার্থীদের হস্তক্ষেপে টুর্নামেন্ট চলমান থাকে।
বিষয়টি সমাধান করতে সেদিন রাত ২ টায় আয়োজক কমিটি অর্থাৎ ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেস্ট রুমে আলোচনায় বসে। সেখানেও ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথে ৪৭ ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় সিনিয়ররা ৪৭ ব্যাচের ৫ জন শিক্ষার্থীকে গেস্ট রুম ত্যাগ করতে বলেন। তারা কক্ষ ত্যাগ করার একটু পর ৪৭ ব্যাচের অন্য শিক্ষার্থীরাও গেস্ট রুম থেকে বের হয়ে যায়।
পরক্ষণেই উত্তেজিত অবস্থায় ৪৭ ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে হলের ২য় তলায় উঠে আসেন। সেখানে অবস্থিত হল মসজিদের সামনে রাখা মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য টবে লাগানো গাছ ও ফুলের টব ভাঙ্গচুর করে এবং উপর থেকে নিচ তলায় ছুঁড়ে ফেলে।
এরই সাথে ২য় তলায় অবস্থিত ২৩৭ ও ২৩৮ নাম্বার রুম ভাঙ্গচুর করে ৪৭ ব্যাচের উক্ত শিক্ষার্থীরা। রুম ২ টিতে অবস্হান করতেন ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও হল ছাত্রলীগ নেতা মো. সোহেল রানা ও আহসান আমিন ফাহিম।
এ ঘটনা জানাজানির পর হলে অবস্হানরত ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও ৪৭ ব্যাচের উক্ত শিক্ষার্থীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কয়েকজন সিনিয়রের হস্তক্ষেপে নিরাপত্তার জন্য ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ২২৬ নাম্বার রুমে এনে রাখা হয়। তার পরপরই হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক সোহেল আহমেদ হলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের কয়েকজন সদস্য এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তারা হলে আসেন। রুম ভাঙ্গচুরের সময় জানালার কাচ লেগে আহত হওয়া নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসান আল মাসুদকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়।
উত্তেজনা প্রশমনে ভাঙ্গচুরে জড়িত কয়েকজন শিক্ষার্থীকে সেদিন রাতে হলে অবস্থান করতে নিষেধ করে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা। তবে ৪৭ ব্যাচের ১৯ জন শিক্ষার্থীই তখন একসাথে হলের বাইরে চলে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঘটনার ২ দিন পর এদের মধ্যে ৪ জন ছাড়া বাকি সবাই হলে ফিরে আসেন।
ঘটনার পরদিন রুম ভাঙ্গচুরে অভিযুক্ত ৪৭ ব্যাচের ৪ শিক্ষার্থী অলক কুমার পাল, হাসান আল মাসুদ, আকাশ তালুকদার ও মোস্তফা ফয়সাল রাফির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্হা গ্রহনের দাবি জানিয়ে হলের প্রাধ্যক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. সোহেল রানা ও আহসান আমিন ফাহিম।
অভিযোগ দায়েরের বিষয়ে সোহেল রানা বলেন, ঘটনার সময় আমরা হলের মাঠে ছিলাম। ৪৭ ব্যাচের জুনিয়ররা যখন লাঠিসোটা নিয়ে করিডোর যাচ্ছে দেখে আমরা উপরে উঠলাম। কয়েকজন শিক্ষার্থী তখন আমাদের রুম ভাঙ্গচুর করতেছিল। ৪৬ ও ৪৭ ব্যাচের দ্বন্দ্বে আমরা ৪৫ ব্যাচই অভিভাবকের ভূমিকা পালন করার কথা। সেখানে ৪৭ ব্যাচের কয়েকজন এসে ভাঙ্গচুর করলো আমাদের রুম। বিষয়টি খুবই কষ্টদায়ক। চাক্ষুষ প্রমাণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের স্বাক্ষের ভিত্তিতে আমরা ৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি। আমরা চায়নি কেউ অন্যায় ভাবে শাস্তির সম্মুখীন হোক। কারণ এরা আমাদেরই ছোট ভাই। তাই যারা প্রকৃত জড়িত তাদেরকেই অভিযুক্ত করেছি। আমরা তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির গ্রহনের দাবি জানাচ্ছি। নয়তো এরকম ঘটনা হলে বারবার ঘটবে।
টুর্নামেন্ট আয়োজক কমিটির সদস্যরা জানান, ৪৭ ব্যাচের খেলোয়াড়রা ম্যাচ হেরে মাঠেই উশৃংখল আচরণ শুরু করে। খেলা ভন্ডুল করতে ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীদেরও বকাঝকা করে মাঠ ত্যাগে বাধ্য করে। এমনকি টুর্নামেন্ট বন্ধু করার হুমকিও দেয়। এ ঘটনায় একটা সমঝোতা করতে আমরা তাদেরকে নিয়ে রাতে আলোচনায় বসি। সেখানেও কয়েকজন আমাদের সাথে বাকবিতন্ডা শুরু করে। এক পর্যায়ে রুম থেকে বের হয়ে উপরে উঠে ভাঙ্গচুর শুরু করে। রুম ভাঙ্গচুরের সময় কাঁচের টুকরো লেগে তাদের একজন আহত হয়। পরে সেটা আমরা মেরেছি বলে অভিযোগ করে যা একেবারেই মিথ্যা। এছাড়াও তারা বাইরে থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে সকলের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। হলের সিনিয়রদের সাথে এরকম আচরণ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যারা করেছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির দাবি করছি।
ঘটনার বিষয়ে ৪৭ ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, "খেলার সময় তেমন বড় কোন সমস্যা হয়নি। একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে হালকা বাকবিতন্ডা হয়েছিল। খেলা শেষে রাতে ৪৬ ব্যাচের ভাইয়েরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আমাদেরকে গেস্ট রুমে ডাকেন। সেখানে কিছু তর্কাতর্কি হওয়ায় আমাদের ৫ জন বন্ধুকে সিনিয়র ভাইয়েরা রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। ওই ৫ জন চলে যাওয়ার সময় আমাদের সবাই বের হয়ে যেতে চাইলে সিনিয়ররা বাঁধা দেন। এ সময় কিছুটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে আমরা সবাই গেস্ট রুম থেকে বের হয়ে যায়। বের হওয়ার পর উপরে ভাঙ্গচুরের শব্দ পায়। ২য় তলায় এসে মসজিদের ফুলের টব ও ২ টা রুমের জানালা ভাঙ্গা অবস্থায় দেখি। এ কাজটা কে করেছে আমরা দেখিনি। তবে যে ই একাজ করে থাকুক আমরা তার শাস্তি দাবি করছি। ঘটনার পর আমরা বিশৃঙ্খলা এড়াতে হলের বাইরে অবস্থান করেছিলাম। পরে প্রায় সবাই হলে চলে এসেছি। আগের মত সবাই মিলেমিশে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবো।"
ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও তাদেরকে পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায় ভাঙ্গচুরের ঘটনায় অভিযুক্ত ৪ জন ছাড়া ৪৭ ব্যাচের সব শিক্ষার্থীই হলে অবস্থান করতেছে। এদের মধ্যে সাজ্জাদ, তানভীর, মাসুম, কবির, সজীব ও সৌরভ ২১৪ নাম্বার রুমে, অন্তর, সায়েম, হিমেল, ইফতি ও নাসির ২২৬ নাম্বার রুমে এবং অভিজিৎ, শৌনক ও শোয়েব ২২৮ নাম্বার রুমে অবস্থান করতেছে।
ঘটনার বিষয়ে হল ছাত্রলীগের ৪৪ ব্যাচের নেতারা জানান, খেলা চলাকালীন ৪৬ ও ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বাকবিতন্ডার কারণে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে সেটা প্রায় সমাধান হয়ে গেছে। সেদিন রাতে ভাঙ্গচুরের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ৪৭ ব্যাচের ৪ জন শিক্ষার্থীকে আমরা নিরাপত্তার খাতিরে হলে থাকতে বারণ করেছিলাম। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুসারে ও সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ওই ৪ জন ছাড়া ৪৭ ব্যাচের অন্য সব শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে এসেছে। ছাত্রলীগ কর্মী হলেও তদন্তে উক্ত ৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমরা তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করবো। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্হাও নেয়া হবে। আমরা সবাই মিলে হলে সুন্দর ও ভ্রাতৃত্ব পূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে চায়। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ছাত্রলীগে কোন স্হান নেই।
হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ বলেন, খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে সৃষ্ট ঘটনা আমাকে মর্মাহত করেছে। ঘটনার খবর পাওয়ার সাথে সাথেই আমি হলে গিয়ে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছিলাম। বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্ত করতে আমি তার পরদিনই তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলাম। রুম ভাঙ্গচুরের ঘটনায় ভুক্তভোগী ২ জন শিক্ষার্থী পরবর্তীতে আমাকে উক্ত ঘটনায় সরাসরি জড়িত ৪৭ ব্যাচের ৪ জন শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই ৪ জনকে শোকজ করা হয়েছে। তারা স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করবে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা গ্রহন করা হবে। নিরপরাধ কেউ শাস্তি পাবেনা। মসজিদের জিনিস ও সরকারী সম্পদ বিনষ্ট করার মত ঘৃণ্যতম কাজ যারা করেছে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্হা নেয়া হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: