প্রতিদিনের ন্যায় আপনি আজও ঘুম থেকে উঠে মোবাইলটা হাতে নিলেন এবং দেখলেন আপনার পরিচিত অনেকে ফোন দিয়েছিলো। আপনি ভাবছেন হঠাৎ আজ এতো ফোন। আপনার ভাবনা শেষ হতে না হতেই আপনার ফোন বেজে উঠলো এবং আপনি রিসিভ করা মাত্রই শুনতে পেলেন, অপর পাশের মানুষটি আপনাকে বকাঝকা ও গালমন্দ করে ফোনটা কেটে দিলো। কি আশ্চর্য, আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। যাইহোক, এরপর আপনি ফেইসবুকে গিয়ে দেখলেন আপনার বন্ধু আপনাকে একটা ভিডিও ইনবক্স করেছে। আপনি ভিডিওটি দেখতেই আপনার চোখ কপালে, কারণ ভিডিওটি অশ্লীলতায় ভরপুর আর ভিডিওর মানুষটি ছিলেন আপনি । অথচ এ ধরনের অশ্লীল ভিডিও আপনার দ্বারা সম্ভবই না। কিন্তু প্রযুক্তির এ যুগে আপনার কথা বিশ্বাস কে করবে? প্রযুক্তির কবলে আপনি এখন আতঙ্কিত। এমনই এক আতঙ্কের নাম ডিপফেক।
ডিপফেক হচ্ছে নকল ভিডিও যা দেখতে হুবহু বাস্তবের মতো। এটি এতই ভয়ানক যে, এর দ্বারা একজন ব্যক্তির কণ্ঠস্বরও হুবহু নকল করা সম্ভব। আর মুখের পুনঃনির্মাণ সম্পূর্ণরূপে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করার প্রথম সিস্টেম এটিই। ১৯৯০ এর দশকে মেশিন লার্নিংয়ের প্রয়োগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর ভিত্তি করে ডিপফেক প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হলেও, ডিপফেক ভিডিওর প্রথম উদ্ভাবন হয় ১৯৯৭ সালে ”ভিডিও রিরাইট” প্রোগ্রামের মাধ্যমে। মূলত, এটি সিনেমায় ডাবিংয়ের কাজের জন্য তৈরি হলেও, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে দুষ্টু লোকদের ছোঁয়ায় এটি এখন অশ্লীল-পর্ন ও মিথ্যা-বানোয়াট ভিডিও তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এর দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন সেলিব্রিটিরা। এরই প্রকাশ ঘটে ২০১৭ সালে ইন্টারনেটে বিশেষভাবে রেডিটে ( ‘রেডিট’ একটি আমেরিকান সামাজিক সংবাদ সমষ্টি, বিষয়বস্তুর গুণগত মান নির্ণয় এবং আলোচনার ওয়েবসাইট) দেখা যায় ডিপফেক পর্নোগ্রাফি। যেটি প্রথম মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তা হলো ব্রিটিশ অভিনেত্রী ‘ডেইজি রিডলির’ ডিপফেক ভিডিওর মাধ্যমে, যা বেশ কয়েকটি নিবন্ধে প্রদর্শিত হয়েছিল। এখান থেকেই ডিপফেক ভিডিওর বিস্তার। এছাড়াও ২০১৮ সালের ১৭ এপ্রিলে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার, ২০১৯ সালের ১৪ জুনে মার্ক জুকারবার্গ, ২০২২ সালের ১৭ মার্চে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি এর ডিপফেক ভিডিও প্রকাশ পেয়েছিল। সম্প্রতি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও কিছু জনপ্রিয় অভিনেত্রীর ডিপফেক নোংরা ভিডিও প্রকাশ পায়। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও একটি ডিপফেক ভিডিও ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আমাদের বাংলাদেশও এর অভিশাপ থেকে মুক্ত নয়। ইতিমধ্যে কিছু ব্লগার ও রাজনীতিবিদদের ফেক ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে।
সব প্রযুক্তিরই ভালো এবং খারাপ ব্যবহার রয়েছে, কিন্তু ডিপফেক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত যেই পরিমাণ অপব্যবহার হয়েছে, তা আসলেই মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এআই ফার্ম ডিপট্রেস সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে অনলাইনে ১৫,০০০ ডিপফেক ভিডিও খুঁজে পায়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এর মধ্যে ৯৬% পর্নোগ্রাফিক ভিডিও এবং এর ৯৯% হলো নারী সেলিব্রিটিদের চেহারা পর্ন তারকাদের চেহারা দ্বারা পরিবর্তিত করা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ফেক ভিডিও সেলিব্রিটি জগতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্পর্কে বোস্টন ইউনিভার্সিটি আইনের অধ্যাপক ড্যানিয়েল সিট্রন বলেছেন, “ ডিপফেক প্রযুক্তি নারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে।” দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ফ্রান্সেসকো মার্কোনি বলেছেন, “ পরবর্তী প্রজন্মের যত গুজব সংবাদ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত হবে।” এছাড়াও সাইবার মিডিয়া রিসার্চের বিশেষত প্রভু-রাম বলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই ছবি ও ভিডিও বিকৃত করার বিষয়টি চলে আসছে, তবে ডিপফেকের মতো ভিডিও বিকৃতির বিষয়টি সামাজিক প্রেক্ষাপটে সত্যিকারের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।”
ডিপফেক ভিডিও শনাক্তকরণে এখনও তেমন কোনো প্রতিকার নেই। তবে গবেষকরা এটি শনাক্তকরণে প্রাণবন্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর হ্যানি ফরিদ স্যার গত বিশ বছর ধারে ডিজিটাল জালিয়াতি নিয়ে গবেষণা করছেন। ইতিমধ্যে কিছু সাফল্যও পেয়েছেন। যেমন তিনি ডিপফেক ভিডিও সনাক্তকরণে বলেছেন, “কথা বলার সময় মানুষের মুখমণ্ডলে রক্তপ্রবাহে তারতম্য ঘটে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা সম্ভব নয়।” তিনি বলেছেন, ”শনাক্তকরণ পদ্ধতিগুলো গোপন রাখা জরুরি। কেননা এগুলো প্রকাশ পেলে, দুষ্টু লোকেরা তা কাজে লাগাতে পারে, এতে সকল গবেষণা বৃথা যাবে।” এছাড়া ফেইসবুক ও মাইক্রোসফট কর্তৃপক্ষও এটি শনাক্তকরণের প্রাণবন্ত কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রযুক্তির উন্নতি যেমন আমাদের জন্যে আশীর্বাদ, তেমনি বিপর্যয়েরও কারণ। প্রযুক্তির অপব্যবহার সহজেই একজন মানুষের সুনাম-খ্যাতি, ক্যারিয়ার নষ্ট করে দিতে পারে। তাই এখন থেকেই বাংলাদেশের মানুষকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ডিপফেক প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণসহ ডিপফেক সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করতে হবে। ইতিমধ্যে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ক্যালিফোর্নিয়াসহ অনেকগুলো দেশ এর বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ সম্পর্কিত তেমন কোনো কার্যকরী আইন প্রণয়ন নেই। বাংলাদেশ এখন থেকেই যদি সতর্ক না হয়, তাহলে ডিপফেকের ভয়াবহতা গ্রাস করে ফেলবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: