আজ পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। প্রতি বছর এইদিনে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়। এটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উদযাপন দিবস।
দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান-সংহতি জানানোর দিন হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে ১৯০৪ সাল থেকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়।
ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের একটি মার্কেটের সামনে শ্রমিকেরা জমায়েত হয়েছিলো কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে।
সে দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আট ঘণ্টা কর্মপরিসর নির্ধারণ। অর্থাৎ তাঁরা চাইছিলেন, সরকার সব কারখানায় শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা বেঁধে দিক আট ঘণ্টা। জমায়েতের সময় শ্রমিকদের ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। ফলে পুলিশ ও শ্রমিকের মাঝে দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এতে হতাহত সহ অনেকে মারাত্নক ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হন। তবে দরিদ্র শ্রমিকেরা সেদিন প্রতিবাদের ফলে দুটি অর্জন নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। একটি ছিল দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ আর অন্যটি হচ্ছে ওভারটাইম।
শ্রমিকের প্রাপ্য সম্মানটুকু বুঝিয়ে দিতেই ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে–কে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না-খাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে 'বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার' সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং কিছু কট্টর সংগঠন এই দিন মে দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করেন। এছাড়াও পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চিন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সেসব দেশে এমনকি এ উপলক্ষ্যে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়।
এশিয়ার অনেক দেশ শ্রমিক দিবস যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করে থাকে। ১৯২৩ সালের ১ মে ভারতের চেন্নাইয়ে প্রথম শ্রমিক দিবস পালন করা হয়। এরপর থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য বিভিন্নভাবে দিনটি পালন করে আসছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশ সরকার এই দিনকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে।
তবে এত কিছুর পরও একটা শ্রেণি শ্রমিকদের নিয়ে দিবস পালন হচ্ছে এটা মানতে পারেনি। হয়তো ‘শ্রমিক’দের নামে কোনো দিবস পালন করতে লজ্জা হচ্ছিল। তাই তো পরবর্তী সময়ে এটিকে মে মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে ‘মে ডে’ নাম দেওয়া হয়। সেই থেকে শ্রমিকের রক্তে অর্জিত দিবস থেকে মুছে গেল শ্রমিক শব্দটি! আজও আমরা শ্রমিকদের রক্তিম স্মৃতি স্মরণ করি শ্রমিক শব্দটা বাদ দিয়েই।
এখনো আমাদের সমাজে পুরোপুরি ভাবে শ্রমিকেরা তাদের প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত মালিকেরা শ্রমিকদের রক্ত তাদের কর্মঘন্টা আট ঘন্টা করা হলেও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তা মানছেন না আর বেশি কাজ করিয়ে অভারটাইমের মূল্য দেওয়া হচ্ছে না।
বর্তমান শ্রম বাজারে শ্রমিকরা আছেন মহাবিপদে।
করোনার কারণে দেশ-বিদেশ সবকিছু ওলটপালট। তৈরি পোশাক, চামড়া, নির্মাণ ও চা—এই চার খাতে বিপুল শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন, কমেছে মজুরি।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে চার শিল্প খাতের ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন শ্রমিকের মধ্যে ৮০ জনেরই মজুরি কমেছে। আর নারী শ্রমিকের অবস্থা আরও নাজুক। এই চার খাতের নারী শ্রমিকেরা পুরুষের তুলনায় গড়ে ৭৭ শতাংশ কম মজুরি পান।
এই চারখাতের বেশিরভাগ শ্রমিকরা চুক্তির আওতার বাহিরে।
এছাড়া প্রায় প্রতিটিক্ষেত্রেই শ্রমিকরা নির্যাতিত হচ্ছে,
গত কয়েক দিন আগে আমাদের দেশে শ্রমিকেরা তাঁদের দাবি আদায়ের জন্য যখন মাঠে নেমেছেন তখন পুলিশ তাঁদের ওপর গুলি ছুড়েছে। এতে অনেকেয় আহত ও নিহত হয়েছিল। এভাবে কেন গুলি করা হলো তাঁদের? ওঁরা তো অধিকার বা দাবি আদায়ের কথা মালিক পক্ষকে বলতেই পারেন। এই আধুনিক যুগে এসেও কেন শ্রমিক দাবি আদায়ের কথা বলতে গিয়ে রক্তাক্ত হবে? এটা তো কারও কাম্য ছিল না।
শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। আমাদের দেশে শ্রমিক আইন -২০০৬ অনুয়ায়ী সকল শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে ও প্রতিবছর শ্রমিক দিবস পালনের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং মালিকদেরকেও শ্রমিকদের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে এবং শ্রমিকদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে তবেই সমস্যার সমাধান হবে।
আজকের মে দিবস শ্রমিকের রক্তে অর্জিত দিবস। শ্রম শব্দটি শ্রমিকের জন্যই। একটি রাষ্ট্র টিকে থাকে শ্রমিকের শ্রম শক্তিতেই। এ দিনটি শ্রমিক নেতাদের মতবাদের মূল্যায়ন ও তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনেরও এক বিশেষ দিন। তাই শ্রমিক দিবস গুরুত্ব নিয়ে পালন করা উচিত। শ্রমিকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার বা তাঁদের কাজের প্রশংসা করলে তাঁরা যেমন আনন্দ পান, তেমনি কাজের প্রতিও উৎসাহ অনুভব করেন। এতে কাজটি আরও সহজ হয়। আমরা সবাই যে যার অবস্থান থেকে শ্রমিকদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবো।
শিবলী নোমান
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: